মহেশতলার ষোলোবিঘা বস্তিতে বারবার আগুন লাগছে। গতবছর ২০১২ সালের ২০ নভেম্বরের পর আবার এবছর ১৬ মার্চ আগুন লেগে বহু ঘর পুড়ে যায়। সকলেই বিস্মিত, কীভাবে বারবার আগুন লাগছে? বস্তিবাসীদের অনেকেই আঙুল তুলেছে মহেশতলা পুরসভার চেয়ারম্যান দুলাল দাসের দিকে। তিনি স্বাভাবিকভাবেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কিন্তু এবার আগুন লাগার পর কয়েকটা ঘটনা বেশ চোখে পড়ার মতো। আগের বাম সরকারের আমল থেকে বর্তমান সরকার, কেউই এই বস্তিকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়নি। এখানে জল বা ইলেকট্রিকের আইনি কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এখানকার ঠিকানায় রেশন কার্ড, আই-কার্ড বা কোনো স্বীকৃতিপত্র দেওয়া হত না। ষোলোবিঘার বাচ্চাদের বাইরের স্কুলেও বহুদিন পর্যন্ত নেওয়া হত না। পরে অবশ্য তা শুরু হয়েছিল। ২০ নভেম্বর আগুন লাগার পর মহেশতলা থানায় কোনো ডায়েরি বা এফআইআর পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। ইমরাজ গায়েন নামে যে বাচ্চাটি তখন পুড়ে মারা গিয়েছিল, তার মৃতদেহ বস্তিতে আনতে দেওয়া হয়নি, প্রশাসনের কড়া তত্ত্বাবধানে বাসন্তী থানার খড়িমাচান গ্রামে ওদের দেশে নিয়ে গিয়ে তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। বাম সরকারের আমল থেকে আজ পর্যন্ত ছ-বার আগুন লাগল। এর আগে এখানে কখনো পুনর্বাসন বা বস্তি গড়ে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ সরকার থেকে নেওয়া হয়নি। এবারই যেন ঘটনা কিছুটা অন্য খাতে এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ইতিমধ্যে রাইট ট্র্যাকের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে দুটো জলের কল (ডিপ টিউবওয়েল) পাওয়া গেছে। একটা বসেছে আকড়া ফটকের নয়াবস্তিতে, আরেকটার মালপত্র ফেলা হয়েছে ষোলোবিঘায়। — সম্পাদক. বস্তি পুনর্গঠনের ছবি সম্পাদকের তোলা, ৩১ মার্চ
২৯ মার্চ, আবদুল কালাম মোল্লা, ষোলোবিঘা বস্তির নাগরিক রক্ষা কমিটির সম্পাদকের বয়ান
এবারে আমরা চাপ দিয়েছি এবং সিদ্দিকুল্লা চৌধুরি বলার পরে এসপি ও ডিএম সাহেব নির্দেশ দেন, ষোলোবিঘা থেকে যতগুলি মানুষ যাবে, থানা তাদের এফআইআর নেবে। আগে ইমরাজ গায়েনের ডেথ সার্টিফিকেট দেয়নি। কিন্তু ১৬ তারিখ সেই ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছে।
দিদি বলেছেন, ষোলোবিঘার জন্য উনপঞ্চাশ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। পেপারেও তা অ্যানাউন্স করেছে। সেই উনপঞ্চাশ লক্ষ টাকার উনপঞ্চাশ পয়সাও আমরা পাইনি। … রাত তিনটে চল্লিশ মিনিটে যে আগুন লাগে, আমাদের ৬১০টি ঘর ভস্মীভূত হয়েছে। আমরা বস্তিবাসী আছি, কে ছিল কে ছিল না ভেরিফাই করে তাদের নাম দেব, যাতে তারা পুনর্বাসনটা পায়। সেই জায়গায় ঘর তৈরি হচ্ছে। এখানে জল এবং স্থল — অনেকে পুকুরের মধ্যে মাচানের ঘর করে ছিল। স্থলটা কম, জলের এলাকা বেশি। তাহলে পুকুরটা ভরাট করে পাইলিং করে তাদের ঘরটা তৈরি করে দেওয়া যায়। যারা টেন্ডার নিয়েছে, তারা বলছে এইভাবে অ্যালটমেন্ট হয়নি, ছ-টা করে ঘর এক লাইনে যাবে। চারফুট বারান্দা আর আট বাই দশ ঘর। তার মাঝে চার ফুট গলি রাস্তা থাকবে। সেখান থেকে উঠে লোকে মেইন রাস্তায় উঠবে, সেটা থাকবে আট ফুট। ছ-টা ঘরের পার্টে পঞ্চাশ ফুটের মাথায় আট ফুট জায়গা ছাড়তে হবে, তাতে বাথরুম অথবা গোসলখানা থাকবে। সেইভাবে ঘর হচ্ছে। জানি না যারা পুকুরে ছিল তাদের ঘরটা কোথায় দেবে।
আমাদের প্রথম দাবি ঘর, দ্বিতীয় দাবি হল স্বীকৃতি মানে পাট্টা দিতে হবে। যাদের রেশন কার্ড আই কার্ড নেই তাদের করিয়ে দিতে হবে, যাদের আছে তাদের ট্রান্সফার করিয়ে আনতে হবে। এখানে যদি বারো হাজার মানুষ থাকে, একশো মানুষের রেশন কার্ড আই কার্ড আছে। বার্থ সার্টিফিকেট এখানে অনেকের আছে। তাতে ঠিকানা লেখা আছে মহেশতলা ষোলোবিঘা, ওয়ার্ড ১১নং।
এরপর রয়েছে পানীয় জলের সমস্যা। এর জন্য আমরা দীর্ঘ তিনমাস আন্দোলন করেছি। এখানে পাল্স পোলিও খেতে দেওয়া হয়নি। জল মানুষের প্রধান জিনিস, জল ছাড়া মানুষ বাঁচে না। আমরা বলেছি, আগে জল দিন, পরে পোলিও খাওয়াবেন। সেটা কোনো ডিসাইড হয়নি। এসডিও সাহেব বলে গিয়েছিলেন, পুনর্বাসনের সাথে সাথে দুটো নলকূপ আর দুটো ডিপ টিউবওয়েল দেওয়ার কথা। এখনও পর্যন্ত নলকূপ আর ডিপ টিউবওয়েল ঢোকেনি। দীপা দাসমুন্সি এসে বলেছিলেন, ষোলোবিঘার জন্য আমি চারটে কল বরাদ্দ করেছি। মুখে বরাদ্দ করলে তো হবে না, লিগালে আসতে হবে। পাহাড়পুরে আর কালীনগর মাঠের কাছে একটা করে নলকূপ আছে, এখন লোকে জল আনে সেখান থেকে।
একটা প্রাইমারি স্কুল এখানে ইমিডিয়েটলি দরকার। এছাড়া আমাদের দরকার একটা কবরস্থান আর একটা শ্মশান, একটা মন্দির আর একটা মসজিদ.
এবারে আগুন লাগানোর জন্য যাদের নামে বস্তির লোকে থানায় এফআইআর করেছে, তারা সকলেই রফিক মোল্লার নিজের লোক। রফিক, যার সূত্রে আগেরবার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ও এতদিন পালিয়ে ছিল, শুনছি গতকাল ধরা পড়েছে। এদের মধ্যে মোমিনা বিবি (অভিযুক্ত) রফিকের ছোটো শাশুড়ি। সাহানারা বিবি (অভিযুক্ত) রফিক মোল্লার পাঁচ নম্বর স্ত্রী, তার মা মোমিনা। ওর গুষ্টির যে ক-টা আছে, ওরই কথায় ওঠে-বসে। ওর পেশা ছিল এখানে গাঁজা চুল্লু মদের ব্যবসা। প্রথম অংশ যেটা পুড়ে গেছে, সেটার লাস্ট পজিশনে বড়ো পুকুরের কাছে ওর পাকা ঘর। উনি বাড়িওয়ালা ছিলেন, বাড়িতে ভাড়া দিতেন, নিজেও থাকতেন। ওনার চারটে পরিবার, চার জায়গায় ছিটিয়ে রেখেছেন। একটা পরিবারের পাঁচটা ঘর, আরেকটার পাঁচটা, আরেকটার ছ-টা ঘর, নিজস্ব দশ-বিশটা, এইভাবে ওর ব্যবসা ছিল। ওর প্রথম ব্যবসা গাঁজা-মদ, তারপর সুদের টাকা খাটানো। আবদুল রেজ্জাক গাজি (অভিযুক্ত), মোমিনার ছেলে, রফিকের শালা। ও পাইলিং ইত্যাদি ডেলি লেবারের কাজ করে.
রফিক অরিজিনাল বাংলাদেশে ছিল বলে শুনেছি। এখানে অনেকদিন এসেছে, এখন মহেশতলার বাসিন্দা হিসেবে সব কাগজপত্র ওর আছে।
নিতাই হালদার (অভিযুক্ত) বহুতদিন থেকে বস্তিতে আছে। মদ-গাঁজার ব্যবসা, রফিকের সঙ্গেই। এই জায়গাগুলো বিক্রি করেছে রফিক, নিতাই, সাধন এরাই। গরিব মানুষের কাছ থেকে পাঁচ-সাত-দশ-বিশহাজার টাকা নিয়ে পার্ট-পার্ট করে স্কোয়ার ফুটের হিসেবে জায়গাগুলো বিক্রি করেছে। নিতাই আগে ছিল ব্রেসব্রিজে, এখন আছে বরুয়াপাড়ায়.
আবদুল মোল্লা (অভিযুক্ত), ডাকনাম বাবু মোল্লা, এখন ওকে বস্তির মধ্যে পাওয়া যাবে না। রফিক-নিতাইয়ের কথায় এই ছেলেটা ওঠে-বসে। নিতাই যতদিন জেলে ছিল, ও বস্তিতে আসেনি, নিতাই ছাড়া পাওয়ার পর ও এসেছিল। আবার নিতাই পালিয়ে গেছে, বাবু মোল্লাও পালিয়ে গেছে।
বাসন্তী, সন্দেশখালি, গোসাবা, কুলপি, ডায়মন্ডহারবার, ক্যানিং, জীবনতলা, মোটের ওপর এই ২৪ পরগনার (দক্ষিণ) লোক বস্তিতে বেশি আছে। যারা অসহায় দরিদ্র মানুষ, যারা ভিখ করে খায়, লোকের বাড়ি বাসন মেজে খায় বা বিভিন্ন কর্মে লিপ্ত। ষোলোবিঘার বারো-চোদ্দ হাজার মানুষ এই সন্তোষপুর থেকে মেটিয়াব্রুজ বিভিন্ন প্রান্তে ছিটিয়ে যায়। এরা বিভিন্ন কাজের মানুষ। রাজমিস্ত্রি, রঙমিস্ত্রি, প্যারিসমিস্ত্রি, ঢালাইমিস্ত্রি, স্যানিটারি-মিস্ত্রি, পাতকুয়োর মিস্ত্রি, টিউবওয়েলের মিস্ত্রি, ডিজাইন-মিস্ত্রি, দর্জি, বিড়ি-বাঁধার লোক, কাগজ-কুড়ানি, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, রাবিশ ফেলার লোক, মাটি কাটার লোক থেকে শুরু করে ট্যাক্সি ড্রাইভার, রিকশা আর ভ্যানচালক মিনিমাম পাঁচ থেকে সাতশো হবে। এই কর্মের লোক যদি চলে যায়, আমার মনে হয় গার্ডেনরীচ অন্ধকার হয়ে যাবে, মানুষ কাজের লোক পাবে না। বাজারঘাট অচল হয়ে যাবে। এখানে বাড়িওয়ালা আছে দু-হাজার মতো। দেশের বুকে কিছু নেই, এখানে করে খাচ্ছে, এরকম ভাড়াটেও আছে কয়েক হাজার। আমরা চাই সকলেই পুনর্বাসন পাক, ভাড়াটে বলে আমরা উল্লেখ করছি না।
Leave a Reply