২৬ ফেব্রুয়ারি, মেটিয়াব্রুজ, জিতেন নন্দী#
২২ ফেব্রুয়ারি সকালে আখতার হোসেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর শেষ প্রার্থনা-সমাবেশে (জানাজার নামাজে) হাজার হাজার প্রতিবেশী, ছাত্র, আত্মীয়স্বজন সহ স্থানীয় মানুষ তাদের প্রিয় মাস্টারমশাইকে শ্রদ্ধা জানাল। তারপর তাঁকে সমাধিস্থ করা হল কারবালার সমাধিক্ষেত্রে, তাঁর মামা কোরবান থান্দারের পাশে।
সপ্তাহ দুয়েক আগে, তখন কলকাতা বইমেলা চলছিল। আখতার স্যারের বড়ো ছেলে শাকিল আমাকে খবর দিল, বাবা একবার দেখা করতে বলেছেন, আপনার সঙ্গে কিছু দরকার আছে। তখন শীতের প্রকোপ কাটেনি। আমি আরও জানতে পেরেছিলাম, এই সময়টা আখতার স্যার শুয়ে রয়েছেন, বেশ কষ্ট পাচ্ছেন। তাহলে তো আমাকে যেতে হবেই। বইমেলার ব্যস্ততার মধ্যেই আমি ওঁকে দেখতে গেলাম। কিন্তু ওঁর শরীর নিয়ে কী কথা বলব! বললেন, ‘তোমাকে কয়েকটা ফান্ডামেন্টাল কথা বলব বলে ডেকেছি। আমি তোমাকে শুধু একটা কথা বলে যাচ্ছি …’ আমার বুক ভেঙে এল, তাহলে কি আখতার স্যার চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত? কান্না চেপে শুনতে থাকলাম ওঁর শেষ কথাগুলো। কথাগুলো যেন তৈরিই ছিল। বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। খেই হারিয়ে যাচ্ছিল। মিনিট দশেক বলে চুপ করে গেলেন।
আখতার হোসেনের জন্ম মেটিয়াব্রুজের হাজিরতনে ১৯৩৩ সালের জুলাই মাসে। তারপর থান্দারপাড়ার মামাবাড়িতে কোরবান থান্দারের আন্তরিক চেষ্টায় তিনি লেখাপড়া শেখেন। মেটিয়াব্রুজ হাইস্কুল থেকে পাশ করে পরে বঙ্গবাসী কলেজে পড়তে যান। গণিতে ডিস্টিংশন পেয়েছিলেন নিজের চেষ্টায়। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পার্ট ওয়ান পর্যন্ত পড়েন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি একদিকে গণিত, অন্যদিকে মার্ক্সবাদের মৌলিক বইগুলির প্রতি আকৃষ্ট হন। পরে অবশ্য তিনি মার্ক্সবাদ থেকে অনেকখানি গান্ধীবাদ ও অহিংসার ভাবনার দিকে সরে আসেন। শুনেছি একটা বই লিখেছিলেন, ‘
‘ডায়ালেকটিকাল মেথড্স ইন ম্যাথেমেটিক্স’।
বড়তলা তথা মেটিয়াব্রুজ এলাকায় লেখাপড়া, বিশেষত মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী ছিলেন আখতার হোসেন। ১৯৬৬ সালে বড়তলা গার্লস হাইস্কুল এবং ১৯৭৬ সালে বড়তলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁর উদ্যোগ সকলেই স্মরণ করেন। এছাড়া আরও বহু স্কুল গড়ার ব্যাপারে তিনি হাত লাগিয়েছিলেন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন বড়তলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক।
শিক্ষা নিয়ে এত উদ্যোগী, অথচ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাঁর সমালোচনাও ছিল নিরন্তর। শুধু শিক্ষাব্যবস্থাই নয়, আমাদের খাদ্যব্যবস্থা, অর্থনীতি, ধর্ম থেকে শুরু করে সমস্ত সিস্টেমের তিনি ছিলেন আজীবন সমালোচক। শেষের দিকে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে একটা বই পড়াতে চাইছিলেন, তারকমোহন দাসের ‘মানুষ একটা বিপন্ন প্রজাতি’। বড়ো ছেলে শাকিলকে বলে গেছেন, ‘তুমি বইটা জিতেনকে পৌঁছে দিও’। আসলে শেষ সময়ে তাঁর মধ্যে মানবজাতির বিপন্নতা নিয়ে খুব উদ্বেগ হত। শ্রমজীবী (মূলত অসংগঠিত, যেমন দর্জিসমাজ) এবং মেয়েদের জীবনের মধ্যে আশা খুঁজতেন। শেষদিন যখন দেখা হল, বলেছিলেন, ‘নতুন একটা প্রজাতি তৈরি হতে হবে। নতুন প্রজাতির মানুষের মধ্যে ধর্ম থাকবে না। তাদের কোনো বংশ থাকবে না, গোত্র থাকবে না। …’
আখতার হোসেন বেঁচে থাকবেন মেটিয়াব্রুজের মানুষের মঙ্গলচিন্তার মধ্যে।
Leave a Reply