১৫ আগস্ট, জিতেন নন্দী#
শিয়ালদা-বজবজ লাইনে আকড়া স্টেশন সংলগ্ন কসাইপাড়ার ভিতরে বেড়ারবাগান, একটা ছোট্ট অপরিচ্ছন্ন বস্তি। বর্ষাকালে বাসিন্দাদের দুর্গতির শেষ নেই। এখানেই ঘটে গেছে মেয়েটির ওপর গণধর্ষণ। একটি বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে, স্বামী পরিত্যক্তা, দুই সন্তানের জননী। এখনও পর্যন্ত এটা গ্যাং-রেপ বা গণধর্ষণ বলে মনে করা সত্ত্বেও এলাকায় প্রশ্ন উঠেছে মেয়েটির চরিত্র নিয়ে; যে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে তাকে নিগ্রহ করা হয়েছে, সেটাতে সে স্বেচ্ছায় উঠেছিল, নাকি তাকে জোর করা হয়েছিল?
ঘটনাটা ঘটেছে ঈদের দুদিন পরে বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই। তখনও মহেশতলার এই তল্লাটে ঈদের পরব চলছিল পূর্ণমাত্রায়। সন্ধ্যাবেলা চারদিক আনন্দ-ফুর্তিতে জমজমাট। সাড়ে সাতটা নাগাদ মেয়েটিকে একটা সাদা টাটা-ম্যাজিক গাড়িতে তোলা হয়, কিংবা ভিন্ন-মতে সে নিজেই গাড়িতে ওঠে। এই গাড়িগুলো ইদানীং এই অঞ্চলে অটো হিসেবে চলছে।
তিন বছরের ছেলের বায়নায় মা রাস্তায় গেছে তার জন্য ফুচকা কিনতে। রাত এগারোটার সময় তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে। তার আগে ঘণ্টা তিনেক কেটে গেছে, একটা মেয়ে ফুচকা কিনতে গেছে। ওই পাড়াতেই তার তিন বিবাহিত ভাই পরিবার নিয়ে রয়েছে। আত্মীয়-স্বজনও রয়েছে কম নয়। কিন্তু সামাজিক নির্লিপ্তি আর উৎসবের ডামাডোল, কারও যেন হুঁশ নেই! একমাত্র মেয়েটির মা উতলা হয়ে শেষ পর্যন্ত রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন।
ইতিমধ্যে খবর এসেছে, এক তরুণীকে কারা যেন ফেলে রেখে গেছে আকড়া থেকে ডাকঘর যাওয়ার পথের ধারে। শুনে মা গেলেন সেখানে। ক্ষত-বিক্ষত নেশায় বেহুঁশ ছিন্ন বসনা মেয়েকে পেয়ে মা তাকে নিয়ে মহেশতলা থানায় গেলেন। সেখানে প্রথমে কোনো কাগজপত্র না দিয়ে অসুস্থ মেয়েটিকে পাঠানো হল বজবজ ইএসআই হাসপাতালে। সেখান থেকে বিদেয় করে দেওয়ার পর থানা ফের একটা কাগজ দিয়ে মেয়েটিকে পাঠালো বেহালা বিদ্যাসাগর হাসপাতালে। সেখানে অত রাতে তাকে ভর্তি করে নিয়ে চিকিৎসা শুরু হল।
১ আগস্ট দিনেরবেলায় মূল অভিযুক্ত (সম্ভবত তার নাম শেখ সফি) ছাড়া বাকিদের পুলিশ পাকড়াও করে। তাদের প্রথমে পুলিশ হেফাজতে এবং পরে জেল হেফাজতে রাখা হয়। মূল অভিযুক্তকে আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। নিগৃহীতা মেয়ে বাড়িতে ফিরেছে বটে। তবে তার ক্ষতস্থানগুলো ড্রেসিং করাতে নিয়মিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। সেই সঙ্গতিও পরিবারটির নেই।
১ আগস্ট দুপুর পৌনে চারটে নাগাদ হাসপাতালে এসে মহেশতলা থানার পুলিশ মেয়েটির জবানবন্দি লিখিতভাবে রেকর্ড করে। সেটাকেই লিখিত অভিযোগ তথা এফআইআর হিসেবে ধরছে পুলিশ। অথচ আগেরদিন রাতেই মেয়েটি থানায় গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ করেছে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই পুলিশ তাকে প্রথমে ইএসআই এবং পরে বিদ্যাসাগর হাসপাতালে পাঠিয়েছে। তাহলে পুলিশ আগের রাতে মেয়েটার কাছ থেকে পাওয়া প্রথম তথ্য নথিভুক্ত (এফআইআর রেকর্ড) করল না কেন? দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই প্রশ্ন এখনও পর্যন্ত পুলিশকে কেউ করেনি।
ঘটনার পরদিন থেকে ডজনখানেক টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের লোকেরা আকড়া এবং হাসপাতালে আছড়ে পড়েছে। প্রতিবাদী শিল্পী সমীর আইচ ঘটনাস্থলে এবং হাসপাতালে গেছেন। ৫ আগস্ট গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি তরুণীর ধর্ষণের নিন্দা করে আকড়ায় পথসভা করেছে। এরপরই এলাকায় পাল্টা একটা স্বর শোনা যেতে শুরু করে। — মেয়েটা সুবিধের নয়; ওর স্বভাব-চরিত্র ভালো নয়; ও স্বেচ্ছায় গাড়িতে উঠেছিল; ইত্যাদি। সাদা অটোওয়ালারাও অটোর ভিতরে এই কাণ্ডটা ঘটায় একটু অস্বস্তিতে পড়েছে। তাদের তৃণমূল কংগ্রেসের ইউনিয়ন। ফলে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের চেয়েও যেটা বড়ো হয়ে উঠেছে, তা হল, তরুণী একটা ইস্যু। কারও কাছে রাজ্য সরকারের অপদার্থতা, কারও কাছে রাজনীতি, কারও কাছে নারীসমাজের নিগ্রহ, কারও কাছে আকড়া অঞ্চলের অটোওয়ালাদের ইজ্জত-রক্ষার ইস্যু!
আজ জোরালো মাইক নিয়ে কংগ্রেস তরুণীর ঘটনায় সোচ্চার হয়েছে আকড়া স্টেশনের পাশে। আর এসব চিল-চিৎকারে হারিয়ে যাচ্ছে একজন সামান্য মেয়ের শরীর, মন আর সামাজিক সম্মানের সাদামাটা প্রশ্নগুলো।
Leave a Reply