সুবীর বিশ্বাস, ছাত্র, এ.বি.এন.শীল কলেজ, কোচবিহার#
একটা ছোট ঘটনা, বেশিদিন আগেরও নয়, এই জুন মাসের ১৬ তারিখ, রবিবার। সব জ্বালা যন্ত্রনার অবসান হল চিত্তরঞ্জনের জীবন থেকে। এটা এক ছেলের গল্প; গল্প এক নেশাখোরের। যে নিজের জীবনটাকে দিয়ে দেওয়ার সময় একবারও ভাবেনি তার সদ্যজাত পুত্রটির কথা বা তার বধূ গরীনির কথা। চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস, পিতা সানু বিশ্বাস, একটা ছোট ভাইও আছে — উদয় বিশ্বাস। এক বোনের এখনো বিয়ে হয়নি, বাকিগুলির অবশ্য বিয়ে হয়েছে।
চিত্তরঞ্জন ছোট থেকে পড়াশোনায় ভালই ছিল। আমার মনে আছে একদিন সেই আমাদের পেটভাতা জুনিয়র হাই স্কুলের ক্রিকেটে জয় এনে দিয়েছিল। কিন্তু তখনকার চিত্ত আর এখনকার চিত্ত — রাত্রি আর দিনের পার্থক্য। IPL খেলার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। কেউ বা আনন্দ পায়, কেউ বা আনন্দ দেয়। কিন্তু এই IPL চিত্তরঞ্জনকে নিয়ে গিয়ছিল বিনোদনের এক বিপরীত জগতে — কালোটাকা, হুমকি তথা খারাপ পৃথিবীর জগতে। যেখানে একবার গেলে আর ফিরে আসার পথ থাকে না।
২০১২ সালের IPL-এ চিত্তরঞ্জন কিছু জুয়াখোর নেশাবিদদের পাল্লায় পড়ে শুরু করে জুয়ারুদের জীবন। কোন বাধা নিষেধ না মেনেই শুরু হয় দূষিত পৃথিবীতে পথ চলা। শুকটাবাড়ি সে যেত সেলুনের কাজে। সেদিন ছিল IPL -এর ফাইনাল কলকাতা নাইট রাইডার্স বা KKR বনাম চেন্নাই সুপার কিংস বা CSK । বাজিতে হেরেছিল লক্ষাধিক টাকা। তার মাথায় এমন নেশার মন্ত্র চেপেছিল যে লক্ষ লক্ষ টাকা বাজি ধরতেও কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু যতটুকু ভাগ্য তার সঙ্গ দিয়েছিল, তার থেকে বেশিটাই কেড়ে নিয়েছিল। তো অনেক ঋণ, জমি বেচে সেই ঋণ পরিষোধ করেছিল তার পরিবার। অনেক ভর্তসনাও শুনতে হয়েছিল পরিবারের কাছ থেকে।
আবার সেই IPL ম্যাচ, সেই বাজি। এবার কিন্তু জায়গাটা আলাদা — শুকটাবাড়ি না, অসম বাংলা ভূটান সীমান্ত — জয়গাঁ। নেশারু আর জুয়ারুদের ঘাঁটি। মেজাজ হারিয়ে চিত্তরঞ্জন শুরু করেছিল তার জুয়াতে আহুতি দেওয়া। সেমিফাইনালের দিন দুই লক্ষ টাকার আহুতি এবং ফাইনালে CSK এর পক্ষে চার লক্ষ টাকা বাজি ধরেছিল সে। কিন্তু তাকে আবার হারতে হয়েছিল। শুধু আইপিএল এর বাজি নয়, জয়গাঁতেই নিয়মিত ১০-১৫ হাজার টাকার লটারি কাটত চিত্ত এই আইপিএল এর টাকা পরিশোধের জন্যে। এতে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে ঋণের বোঝা, পরিশোধ করা তো মুখের কথা নয়। তাকে পাওনাদারেরা চাপ দিতে থাকে, কিন্তু সে টাকা দেবে কোথা থেকে? কাজেই তাকে মৃত্যুভয় দেখানো শুরু হতে থাকে। সে ভয় পেয়ে তার বাড়িতে জানায়। বাড়িতে প্রথমে তার উপর রাগ করে থাকলেও কিছু সাহায্য করতে সমর্থ হয়। এরপর পাওনাদারের কাছ থেকে আরো চাপ আসলে বাড়ির লোকও তাকে মরতেই বলে। কিন্তু একইসাথে তার বাবা ছোট ছেলে উদয়কে দিয়ে কিছু টাকা পাঠাবার ব্যবস্থা করে।
১৬ জুন রবিবার সকালটা চিন্তাভাবনা করে চিত্তরঞ্জন। দোকান খোলে আর দোকান যাবার আগে সে প্রথমে এন-১০ (কড়া মাত্রার ঘুমের ওষুধ) এবং ইঁদুর মারার বিষ খায় (পরবর্তীতে পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে তার পাকস্থলীতে এই সব জিনিসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়)। দোকানে থাকতে থাকতেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে কাছে দিদির বাড়িতে যায়, আর সেখানেই জ্ঞান হারায়। তারপর স্থানীয় চিকিৎসক এসে দেখে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু জয়গাঁতে হাসপাতাল না থাকায়, তাকে বিকেলের দিকে গাড়িতে করে কোচবিহার আনার পথে সে হাসিমারা সংলগ্ন স্থানে মারা যায়। রাত ১২ টায় তার দেহ মাঘপালায় নিজের বাড়িতে আনা হয়। তারপর পোষ্টমর্টেমের জন্যে কোচবিহারে নিয়ে যাওয়া হয়।
IPl এর মত টুর্নামেন্ট দেখিয়ে দিয়ে গেল সমাজের একেবারে উপর মহল থেকে শুরু করে একেবারে নীচুতলা পর্যন্ত কিভাবে ছড়িয়েছে জুয়ার বীজ। এভাবে শুধু একজন চিত্তরঞ্জন এর ঘটনা থেকে আন্দাজ করতে পারি আরো কত চিত্তরঞ্জন এখনো এভাবেই ঘোরতর বিপদের মধ্যে আছে।
Leave a Reply