শমীক সরকার, কলকাতা, ৩০ জুন#
এবছরের জানুয়ারি মাসে ভোটে জিতে গ্রীসের ক্ষমতায় এসেছিল নয়া বামপন্থী জোট সিরিজা — গ্রীসের ইতিহাসে প্রথমবার। কৃচ্ছসাধন বিরোধী দক্ষিণপন্থী দল আনেল-এর সাথে জোট বেঁধে সরকার গঠন করেছিল তারা। সিরিজা-আনেল জোটের প্রতিশ্রুতি ছিল : ঋণগ্রস্ত গ্রীসের অর্থনীতির পুনর্গঠন, আইএমএফ-ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ফর্মুলা মেনে কৃচ্ছসাধন নয় বরং গ্রীসের সাধারণ জনগণের দিকে তাকিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে দেশের ঋণের দীর্ঘমেয়াদী পরিশোধ পরিকল্পনা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে না বেরোনো।
মাঝের কয়মাস ধরে জোটের অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারুফাকিসের নেতৃত্বে বার বার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (যে ইউনিয়নের মাতব্বর জার্মানি ও ফ্রান্স রাষ্ট্র) সাথে রফাসূত্র বের করার চেষ্টা করে গ্রীস। গ্রীসের এই প্রয়াসকে স্পেনের পোডেমস সহ ইউরোপের প্রতিবাদী রাজনীতিক দলগুলি সমর্থন জানায়। কিন্তু গ্রীসের সাধারণ জনগণের দিকে তাকিয়ে কোনো রফাসূত্রে রাজি হয়নি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আইএমএফ। বরং তারা ২৫ জুন একটি নয়া প্রস্তাব দেয় গ্রীসকে — তাতে নির্দেশ দেওয়া হয় : ১) ওষুধ, বই, থিয়েটারের ওপর ৬ শতাংশ পরিষেবা কর; নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও বিদ্যুতের ওপর ১৩ শতাংশ এবং বাকি সমস্ত কিছুর ওপর অন্তত ২৩ শতাংশ পরিষেবা কর নিতে হবে গ্রীস রাষ্ট্রকে। (বলাই বাহুল্য, এর ফলে আর এক প্রস্থ চরম মূল্যবৃদ্ধির মুখে পড়বে গ্রীস। গ্রীসের মূল শিল্প আন্তর্জাতিক পর্যটন, চড়া করের জন্য তা মার খাবে।) ২) গ্রীসের দ্বীপগুলোতে করের কোনো ছাড়া রাখা চলবে না। (পর্যটন মার খাবে এর ফলে।) ৩) অবসরের সময় বাড়িয়ে সাতষট্টি বছর করা। (পেনশন খাতে সরকারি খরচ কমবে, কিন্তু বেকারত্ব আরো বাড়বে।) ৪) দরিদ্রদের পেনশনের সুযোগ সবিধা বাতিল করতে হবে। ৫) স্বাস্থ্যখাতে পেনশনারদের কাছ থেকে আরো বেশি টাকা কেটে নিতে হবে। ইত্যাদি।
এইসব দাওয়ায় আসলে কৃচ্ছসাধনবিরোধী জোট সরকারের গ্রীসের সাধারণ জনগণের দিকে তাকিয়ে নেওয়া উদ্যোগগুলিকেই বানচাল করে দেবে। তাই গ্রীসের জোট সরকার একটি বিকল্প দাওয়ায় দিয়েছিল, কিন্তু ফের তা মানতে চায়নি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আইএমএফ। শেষমেশ হঠাৎ করেই ২৭ জুন গ্রীসের রাষ্ট্রপ্রধান আলেক্সিস সিপারাস ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক এবং আইএমএফ-এর দেওয়া দাওয়ায় সমৃদ্ধ প্রস্তাবটির পক্ষে বিপক্ষে গণভোটের প্রস্তাব দেন। পরদিন গ্রীক সংসদ এই প্রস্তাব ভোটাভুটির পর মেনে নেয়। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানায় সিরিজা, আনেল এবং অতি দক্ষিণপন্থী দল গোল্ডেন ডন। বিরোধিতার কারণ উল্লেখ করে সিরিজা বলে, এই দাওয়াই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যদি গ্রীসকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্গত দেশ বলে ধরতে হয়, তাহলে গ্রীসের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানের থেকে এত নিচু করে রাখার প্রয়াস চলবে না। তাছাড়া এই দাওয়ায়ের মাধ্যমে গ্রীস দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে ঋণদায়ী সংস্থাগুলো।
প্রসঙ্গত, গ্রীস দেশটি বেশ কয়েকবছর ধরে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীণ। আইসল্যান্ড, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশের মতোই আইএমএফ-এর দাওয়ায় মানতে গিয়ে ধার করে চলতে চলতে দেশটির ধারের পরিমাণ এখন তার মোট সম্পদ (জিডিপি)-র ১.৭৭ গুণ। মোট ৩২০ বিলিয়ন ইউরো (১ বিলিয়ন = ১০০ কোটি, ১ ইউরো = ৭১ টাকা) ধার, তার মধ্যে বিভিন্ন সময় ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের কাছ থেকে নেওয়া ধার ২৪০ বিলিয়ন ইউরো। দেশের কর্মচারীদের বেতনটুকু দেওয়ার জন্য ধার করা রীতিতে পরিণত করে ফেলেছিল বামপন্থী পাসোক এবং দক্ষিণপন্থী নিউ ডেমোক্রেসির দখলে থাকা পুরনো সরকারগুলি। তার সঙ্গেই চলত আইএমএফ-ইসিবির কৃচ্ছসাধনের দাওয়ায় এবং ফের একপ্রস্ত ধার করে পুরনো ধারের সুদ ফেরত দেওয়ার পালা। আর আইএমএফ-ইসিবি গ্রীস সরকারের সমস্ত হিসেব কিতেব মিলিয়ে মিলিয়ে দেখত, বাজে খরচ হচ্ছে কি না। গ্রীসের বেকারত্ব প্রায় ২৬ শতাংশ। কৃচ্ছসাধন (চড়া দাম, কম বেতন, কম পেনশন, বেকারত্ব)-এর সাথে তাল মিলিয়েই দেশের সার্বভৌমত্বটুকুও খোয়াতে বসেছিল চিরাচরিত পাসোক-নিউ ডেমোক্রেসির শাসনে থাকা গ্রীস। এই অবস্থাতেই গ্রীসে লাগাতার জনবিক্ষোভের পাশাপাশিই কৃচ্ছসাধনবিরোধী দুটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটতে শুরু করে। একটি হল নয়া বামপন্থী সিরিজা জোট। আরেকটি অতি দক্ষিণপন্থী গোল্ডেন ডন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব সীমিতই থেকে যায়। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্ধারক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় সিরিজা জোট, একটি-দুটি আসন কম ছিল পূর্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে, তাই তারা দক্ষিণপন্থী কিন্তু কৃচ্ছসাধনবিরোধী ছোটো দল আনেল-এর সাথে জোট বেঁধে সরকার গঠন করেছিল।
ক্ষমতায় আসার পর ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রীস সরকার ঋণদানকারী আইএমএফ-ইসিবি-দের সঙ্গে ঐক্যমত্যে এসেছিল, ধার শোধের প্রথম কিস্তি তারা ৩০ জুনের মধ্যে শোধ করবে। পরের কিস্তি জুলাই-এ, তারপরের কিস্তি আগস্টে। প্রথম কিস্তির ৬.৭৪ বিলিয়ন ইউরো আইএমএফ, ইসিবি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। ফেরত দিতে পারেনি তারা। পরবর্তী কিস্তি ৫.৯৫ ইউরো জুলাই-এর ২০ তারিখের মধ্যে ফেরত দেওয়ার কথা।
অবশ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সংবিধানে কোথাও বলা নেই, ঋণশোধ না করতে পারলে গ্রীসকে ইউরোজোন বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া যাবে। গ্রীসের এই গণভোটের প্রস্তাব এবং তাতে শাসক জোটের চ্ছ্রনা’-এর পক্ষে অবস্থান নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের মাতব্বর-রা (জার্মানি, ফ্রান্স ইত্যাদি রাষ্ট্র) এই গণভোটকে গ্রীস আদৌ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকবে কি না তার গণভোট হিসেবে অভিহিত করেছেন। ইউরো-ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-ইউরোজোন থেকে গ্রীসের চলে যাওয়াকে ইংরেজি শব্দবন্ধ চ্ছ্রগ্রেক্সিট’-এর মাধ্যমে চিহ্নিত করে, তা গ্রীস তথা ইউরোপের দুয়ারে কড়া নাড়ছে কি না তা নিয়ে বিস্তর জল্পনা শুরু হয়েছে। কিন্তু গ্রীসের অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারুফাকিস দাবি করেছেন, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে সরে যাচ্ছেন না। ইউরোপের সাধারণ মুদ্রা ইউরো থেকে সরে এসে পুরনো গ্রীক মুদ্রা ড্রাকমা-তে ফিরে আসারও কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।
গণভোট ঘোষণার পরদিনই গ্রীসের লোকজন ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখতে পায়, দৈনিক ৬০ ইউরোর বেশি তারা ব্যাঙ্ক থেকে তুলতে পারছেন না। ব্যাঙ্ক থেকে সরাসরি টাকা তোলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ফলে পেনশনাররা মাসের শেষদিন গিয়ে পেনশন তুলতে পারেনি। গ্রীস সরকার ধনীরা যাতে টাকা পয়সা তুলে নিয়ে গ্রীস ছেড়ে না পালাতে পারে, তার জন্য এসব বন্দোবস্ত করেছে। একইসাথে বিভিন্ন সরকারি আধাসরকারি সংস্থাগুলোকে তাদের ফান্ড সরকারকে দিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। ইউরোপের মাতব্বর এবং অর্থনীতিবিদরা বলাবলি করছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন, পেনশন, ভাতা দেওয়ার মতো টাকাটুকুও গ্রীসের তহবিলে নেই। কিন্তু গ্রীস সরকার দাবি করেছে, সরকারি মাসিক খরচ সামলানোর জন্য তাদের হাতে পর্যাপ্ত পয়সা রয়েছে।
mitra chatterjee says
sahoj sarol bhabe khoborer uposthapona
niropekkho o bote