রাজীব দত্ত, আকড়া, মহেশতলা, ১৬ আগস্ট। পহেলগাঁওয়ে লিডার নদী-উপত্যকা। ছবি প্রতিবেদকের।#

কলকাতা থেকে দুটো গাড়ি যায় জম্মু পর্যন্ত, একটা হিমগিরি আর একটা জম্মু-তাওয়াই। হাওড়া থেকে সুপারফাস্ট গাড়ি হিমগিরি এক্সপ্রেস ধরেছিলাম। সুপারফাস্ট হওয়ার জন্য বাড়তি পয়সাও গুনতে হয়েছিল। দুপুর বারোটা কুড়িতে জম্মু পৌঁছানোর কথা ছিল, আমি নামলাম রাত পৌনে এগারোটায়। সারা বছর ধরে বৈষ্ণোদেবীর দর্শন চলে। জম্মু থেকে বৈষ্ণোদেবীর বেসক্যাম্প কাটরায় পৌঁছাতে এক ঘণ্টার মতো সময় লাগে। জম্মু শহরটায় সারাক্ষণই কাটরায় যাওয়ার গাড়ি চলছে। কেউ ট্রেন থেকে নামলেই ণ্ণযাবেন যাবেন’ করে ডাকছে। অত রাতে জম্মুতে পৌঁছেও হোটেল পেতে অসুবিধা হয়নি। গাড়িঘোড়াও চালু ছিল। স্টেশনের কাছেই একটা হোটেলে ঘর নিলাম। ঠিক করলাম সকালবেলা উঠেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পহেলগাঁওয়ের বেসক্যাম্পে পৌঁছে যাব। আমরা দুজন ছিলাম। একটা গোটা গাড়ি নেওয়া আমাদের পক্ষে মুশকিল আর বাসে যেতেও অনেক সময় লাগে। ট্রেনে আলাপ হয়েছিল চুঁচুড়ার একজন ডাক্তার, তাঁর স্ত্রী আর কম্পাউন্ডারের সঙ্গে। ওঁরাও বৈষ্ণোদাবী যাচ্ছেন। ওঁদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মোট পাঁচজন মিলে একটা গাড়ি বুক করলাম। ভোর পাঁচটার সময় সেই গাড়ি হোটেল থেকে আমাদের তুলবে। পরদিন একদম পাঁচটায় ছেড়ে বেলা সওয়া একটা নাগাদ গাড়িটা আমাদের পহেলগাঁওতে পৌঁছে দিল।
জম্মু থেকে পহেলগাঁও ২৯৫ কিলোমিটার মতো রাস্তা। আমি ভারতবর্ষের যত পাহাড়ে গেছি, কাশ্মীর তার চেয়ে একেবারে আলাদা। সাধারণত পাহাড়ি উপত্যকাগুলো কিছুটা সংকীর্ণ হয়, পাহাড়ি নদীর কারণেই। নদী যেভাবে পাহাড় থেকে নেমে আসে, তার গতি বেশি হওয়ার জন্যই বিস্তারটা কম হয়। কিন্তু কাশ্মীরের নদীগুলো আসছে চীন বা তিব্বত থেকে, কিংবা হিমাচল থেকে, এখানে ঢুকতে ঢুকতে নদীগুলো তার গর্ভকে চওড়া করার সুযোগ পেয়ে গেছে বলে মনে হয়। গাড়িতে করে গেলে দেখা যায়, দুটো পাহাড়ের মধ্যে দূরত্ব অনেক বেশি। মাঝে চাষ আছে, গাছপালা অনেক বেশি। এটা পরে আরও ভালো বুঝেছিলাম কাশ্মীর উপত্যকায় গিয়ে। যাই হোক, রাস্তায় পাটনী টপ এল, তারপর বানিহাল। বানিহাল পার হওয়ার পর উপত্যকার এই বৈশিষ্ট্যটা আরও ভালোভাবে দেখতে পেলাম। এরপর এল জওহর টানেল। প্রায় পৌনে তিন কিলোমিটার লম্বা সুরঙ্গে দুটো সমান্তরাল লেন, একদিক দিয়ে ঢোকা, আর একদিক দিয়ে বেরোনো। টানেলের মধ্যে গাড়ি দাঁড় করাতে দেয় না। তবে যাওয়ার আগে সবাই যেমন বলেছিল, এই জায়গাটায় সিকিউরিটির খুব কড়াকড়ি। আমার তেমন মনে হল না। আছে কিছুটা, তবে ছবি-টবি তোলাও যায়।
তীর্থযাত্রার ব্যাপারটা মন থেকে একটু সরিয়ে রাখলে মনে হয়, পহেলগাঁও একটা পিকচার পোস্টকার্ডের মতো সুন্দর। ওরকম একটা নদী, তার দুপাশে উপত্যকা, অপূর্ব! এমনকী স্থানীয় মানুষও সুন্দর। চারদিকে গান-টান হচ্ছে, প্রচণ্ড ভক্তিমূলক। জম্মু থেকেই শুনছিলাম যে যাত্রাপথে খাবারদাবারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। সমস্ত পথটাতেই রয়েছে ভাণ্ডারা। গোটা ভারতবর্ষ থেকে এলেও দিল্লি, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশের কিছু এবং অবশ্যই গুজরাতের মানুষের আগমন সবচেয়ে বেশি। আমি যে কোনো জায়গায় গেলে স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে পছন্দ করি। মাঝরাস্তায় আমাদের ড্রাইভার বিলাল যেখানে খাওয়ার জন্য গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল, সেখানে ও কাশ্মীরের নুন-চা খাইয়েছিল। খুব অসাধারণ কিছু না হলেও বেশ অন্যরকম তার স্বাদ। তিব্বতীদের মাখন-চায়ের মতো ঠিক নয়। সম্ভবত সেটা এদের সাধ্যের বাইরে। কিন্তু এরা নুনটা কেন ব্যবহার করে? আমার মনে হল, দুটো কারণ। এক, চিনি এদের কাছে বেশ মহার্ঘ্য; তাছাড়া পাহাড়ে শরীরের যে জলশূন্যতা ঘটে, নুন-চা পান করলে তার কিছুটা পূরণ হয়। পাশে থাকে ছাতু, সেটাও অল্প মিশিয়ে দেয় ওই চায়ে।
কলকাতা থেকেই অমরনাথ যাওয়ার এনট্রি পারমিটের ব্যবস্থা করতে হয়। দুটো গেট দিয়ে অমরনাথে ঢোকা যায়, বালতাল আর চন্দনবাড়ি। চন্দনবাড়ি হল পহেলগাঁওয়ের দিকে। যাত্রাপথ কলকাতা থেকেই স্থির করে নিতে হয়। পারমিটের দরখাস্তে কোন গেট দিয়ে কবে ঢুকতে চাই, তা উল্লেখ করতে হয়। নাহলে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। আমরা একদিন বাড়তি সময় হাতে রেখেছিলাম, পহেলগাঁওতে থাকব। আমাদের পাঁচজনের মধ্যে ওই তিনজন আলাদা হয়ে গেলেন। ওঁদের ঢোকবার দিনটা আগে ছিল। তাছাড়া ওঁরা ঘোড়ায় যাবেন, আমরা যাব পায়ে হেঁটে। আমরা ওখানে তাঁবুতে না থেকে হোটেলে ঘর নিলাম। ভাণ্ডারাতে খেতে গেলাম। সেখানে পিৎজা থেকে পাস্তা, দক্ষিণ ভারতীয় থেকে উত্তর ভারতীয়, যেন পৃথিবীর সবই পাওয়া যায়! নিরামিষ এবং অবশ্যই ভালো মানের খাবার। আমার সঙ্গী বাবাই সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী। ও খেয়ে খুব খুশি। আমি ভাণ্ডারাতে খেয়েও একটু অতৃপ্ত ছিলাম। বিকেলবেলা ঘুরতে বেরিয়ে পহেলগাঁওয়ের চক মার্কেটে গেলাম। রমজান চলছে। আমাদের পাড়ায় ঠেলাগাড়িতে যেভাবে ভুট্টা বিক্রি হয়, সেভাবে কাবাব নিয়ে এল চকের সামনে। সম্ভবত সময়টা ইফতারের ঠিক আগে, বিকেল চারটে সাড়ে চারটে বাজে তখন। আমাকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, ণ্ণবাহার সে আয়ে হো কেয়া?’ আমি বললাম, ণ্ণকলকাতা সে ঘুমনে আয়া’। কথায় কথায় আমি জিজ্ঞেস করলাম, অমরনাথের ওদিকে এখন কী অবস্থা? তিনি বললেন, ণ্ণহালত কেয়া কহে স্যার, কুছ ঠিক নহী হ্যায়। ওঁহা হামারে চার লড়কো ভি মর গয়ে।’ খবরের কাগজে পড়েছি, ওরা মারা গেছে সম্ভবত ১৮ জুলাই, মানে আমরা ওখানে পৌঁছানোর দিন দুয়েক আগে। চন্দনবাড়ির দিকে নয়, বালতালের দিকে যে ক্যাম্পটা, সেখানে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে চারটে ছেলে মারা গেছে। আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, ঘটনাটা ঠিক কী ছিল। এঁরা বললেন, প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারা গেছে ছেলেগুলো। — ণ্ণইজরায়েল যো কর রহে হ্যায় ফিলিস্তিনিয়োঁ কে সাথ, মুসলমানোঁ কে উপর জুলুম উঠা রহা হ্যায়। …’ এইসব শব্দগুলোই এঁরা ব্যবহার করেছিলেন। পাশে একজন ম্যাগি বিক্রি করছিলেন, বয়স্ক মানুষ, তিনি বললেন, ণ্ণহম তো কহা মেরে বেটেকো, তু চলা যা।’ কমবয়সি একজন শুনে আমার দিকে চেয়ে হেসে বললেন — ণ্ণযায়েঙ্গে তো রোটি-রোজি কৌন সামহালেগা?’ — ণ্ণহম সামহাল লেঙ্গে, তু চলা যা।’ কমবয়সি যুবক ইশারায় আমাকে বললেন, ওঁর মাথায় একটু গণ্ডগোল আছে। বোঝা গেল, একটা চাপা ক্ষোভ আছে। সেটা কীসের থেকে কোথায় সঞ্চারিত হচ্ছে, নাকি নিজের কোনো ক্ষোভের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল প্রসঙ্গ, সেটা স্পষ্ট হল না। কিন্তু কীরকম একটা আঁচ লাগল গায়ে।
পরদিন আরু গেলাম। আরু থেকে কোলাহাই হিমবাহে যাওয়ার একটা পথ রয়েছে। আরু পর্যন্ত গাড়িতে গিয়ে কোলাহাইয়ের দিকে ট্রেক করে গেলাম ছ-সাত কিলোমিটার পথ। অমরনাথের পথে চলার আগে পাহাড়ি আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার কাজটা এতে হল। আরু উপত্যকায় নদী আছে। এটা লিডার নদীর একটা শাখা। কাশ্মীরি উপত্যকা আর নদী সব জায়গাতেই সুন্দর, একটা ছবির মতো। আমার পাহাড়ি নদী পেরোনোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি পুরোনো অভ্যাসটাকে একটু ঝালিয়ে নিতে চাইছিলাম। নদীর এপারটা বেশ সাজানো গোছানো, ভালো রিসর্ট আছে, গাড়ি ও লোকজন আসছে যাচ্ছে। একটা বেকারি আছে। রুটি কিনলাম, খেলাম। রিসর্টের পিছনে নদীর ওপরে একটা পুরোনো গাছ পড়ে রয়েছে। আমি বুঝলাম, এখান দিয়ে ওপারে যাওয়া সম্ভব। নদীটা কিছুটা গিয়ে যেখানে দুটো ভাগ হয়ে গেছে, গাছটা ওই অবধি গেছে। আমি ওই অবধি গিয়ে ভাবলাম আরও এগিয়ে ওইরকম কিছু গাছ বা পাথর-টাথর পাওয়া যাবে, ঠিক পার হয়ে যাব। হঠাৎ একটা অদ্ভুত চেঁচামেচি শুরু হল। এপার থেকে কিছু লোক চেঁচাচ্ছে। আমি ভাবছি, লোকে আমার পার হওয়ার চেষ্টা দেখে ভয় পাচ্ছে। পাহাড়ি নদী, ভাবছে হয়তো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমি লাফ দিয়ে টপকে পার হলাম। বেশ খুশি! দেখলাম ওপার থেকে তিনজন মেয়ে কাস্তে-টাস্তে নিয়ে তেড়ে আসছে। আমি ক্যামেরাটা দেখিয়ে ইঙ্গিত করলাম, আমি ট্যুরিস্ট। ফলটা হল উল্টো। ওরা আরও তেড়ে এল। আমি লাফ দিয়ে পালিয়ে এলাম। পরে এপারের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, ব্যাপারটা অন্যরকম। ওরা কাউকে ওখানে ঢুকতে দেয় না। ওরা ওখানে কাঠ কাটে, কাঠ বেচে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক গিয়ে ওদের নাকি বিরক্ত করে — ওদের সংগ্রহ করা জিনিস কেড়ে নেয়, পয়সা চায়, মেয়েদের ওপর জুলুম করে। আমাকে ওরা ভেবেছে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক। ওরা কাশ্মীরি গুজ্জর সম্প্রদায়ের ট্রাইবাল মানুষ।
পরদিন আমরা পহেলগাঁও থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে চন্দনবাড়ি পৌঁছালাম। একটা গাড়ি লিফট দিল। এবার চন্দনবাড়ি থেকে মোট ৩২ কিলোমিটার হেঁটে আমরা যাব অমরনাথে। আমাদের পরিকল্পনা, দুদিনে উঠব, অমরনাথ দেখব আর একদিনে নেমে আসব। ক্রমশ
Leave a Reply