রাজীব দত্ত, আকড়া, মহেশতলা, ১ সেপ্টেম্বর#
অমরনাথের উদ্দেশ্যে হাঁটলাম। বেশিরভাগ অংশটা হিমবাহের ওপর দিয়ে খালিহাতে যাওয়া। ভয়ানক রাস্তা, ঘোড়া আর লোকজনের কারণেই। কয়েকটা জায়গায় চড়াই আছে। তারপর শুরু হল হিমবাহ, কিন্তু সেটা বোঝার মতো অবস্থায় নেই। ঘোড়ার গোবরে, মানুষের পায়ের চাপে পুরো ধ্বস্ত অবস্থা! দেড়মাস ধরে প্রতিদিন দশ হাজার লোক যদি চলে, তাহলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। একটা জায়গায় গিয়ে ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে পড়ে, তার পরে আর ওদের যেতে দেওয়া হয় না। সেখানে কয়েকশো তাঁবু, প্রত্যেকটাতে লোক রয়েছে, যেন সম্মিলিত ভারতবর্ষ! আমি এ জিনিসটা কুম্ভতেও দেখেছি। কিন্তু ১৪,০০০ ফুট ওপরে হিমালয়ে কুম্ভকে নিয়ে আসার দরকার আছে কি? কেউ জামাকাপড় কাচ্ছে, কেউ স্নান করছে, ব্যাপারটাকে একেবারে ঘরবাড়ি করে ফেলেছে, তাতে যা হওয়া সম্ভব তাই হয়েছে। পেচ্ছাপ, পায়খানা, একটা নরক!
সমস্ত পাশ কাটিয়ে উঠলাম। পথের দু-ধারে অনেক প্রসাদের দোকান। দোকানিরা সবাই স্থানীয় মুসলমান। দোকানির কাছ থেকে প্রসাদ কিনলাম দুজনেই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাল তো ঈদ’। সে বলল, ‘কেয়া করে? বাবাকা ইচ্ছা, ইস বার রুকনা পড়েগা।’ আমার কথাটা ভালোই লাগল। অন্তত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ওপরে উঠে ওরা ঘৃণাটাকে অতিক্রম করতে পেরেছে বলে মনে হল। যারা প্রসাদ কেনে, আমি জানি না যে তারা জানে কিনা এই লোকগুলো মুসলমান। এই যে ঘোড়াওয়ালা, ডুলিওয়ালা, পিঠঠুওয়ালা, এরা সবাই তো মুসলমান। একটা কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেও হয়তো এরা এই যাত্রার ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে, সম্পূর্ণ নিরাসক্ত বা নির্লিপ্ত নয়। এটা আমার চমৎকার লেগেছে। নিজের ধর্মে থেকেও এদের এই ব্যবহারটা আমাকে মুগ্ধ করে। সমস্ত সম্পত্তি জমা রেখে উঠতে হয়। ক্যামেরা বাইনাকুলার, মোবাইল সব জমা রাখতে হল। মহিলা-পুরুষ সকলের তল্লাশির আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে।
অমরনাথ গুহা অসাধারণ লাগল। বাটু মালিক নামে যে মেষপালক প্রথম এটা দেখেছিল, সে সম্ভবত কোনো একটা গর্ত দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকেছিল এখানে। অতটা চওড়া গুহামুখ নিশ্চয় ছিল না। পরে পাহাড় কাটিয়ে করা হয়েছে বোঝা যায়। ভিতরে বিস্তৃত চাতাল। গুহার শেষপ্রান্তে লোহার রেলিঙে ঘেরা বরফের প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গ। উচ্চতা ৮-১০ ফুট হবে। বরফ জমা হওয়ার পরিমাণ অনুযায়ী উচ্চতা বাড়ে কমে। পাশেই ছোটো ছোটো আরও দুটি বরফলিঙ্গ। ওরা বলে পার্বতী ও গনেশ। প্রথাগত পূজার কোনো ব্যবস্থা নেই। সেনা জওয়ানরাই প্রসাদী ডালা মন্দিরের বেদিতে ছুঁইয়ে পবিত্র করে ফেরত দিচ্ছে ভক্তদের। দেখে ফিরে আসছি। জায়গাটা ইংরেজি ইউ-এর মতো। পঞ্চতরণি থেকে অমরনাথ ছয় কিলোমিটার। তিন কিলোমিটার যাওয়ার পরে যে রাস্তাটা অমরনাথ গেছে হিমবাহের ডানহাত ধরে, সেই রাস্তাটাই হিমবাহের বাঁ দিক দিয়ে নেমে আসছে। আমি দেখলাম, আমি যদি ইউয়ের মাঝখানটা সরাসরি পার হয়ে যাই, হিমবাহ পড়বে মাঝে, খুব বেশি হলে দু-কিলোমিটার হবে, খামোকা অতটা রাস্তা হাঁটব না।
রাতে ফিরে এলাম পারভেজের তাঁবুতে। কারও সঙ্গী হারিয়ে গেলেই ওখানে আসছে লোকে। মহারাষ্ট্র, আসাম থেকে যেই আসছে, তাকে ওখানে বসিয়ে পারভেজ ঘোষণা করে তার সঙ্গীকে ডাকছে। খুঁজে পাওয়ার পর তাকে ও এই তাঁবুতে থাকতে বলছে। আমরা ভাণ্ডারায় খেয়ে এসে ওকে বললাম, বাবাইয়ের শরীরটা ভালো নেই, আমরা একটু ছড়িয়ে ফাঁকা কোনো তাঁবুতে থাকতে চাই। ও তখন পাশে একটা ফাঁকা তাঁবু আমাদের খুলে দিল। আলো নেই। আমরা ওর মধ্যেই ঢুকে গেলাম। পরদিন পারভেজের টাকা মিটিয়ে সকালে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। একদিনে বালতালে নেমে এলাম। ১৪ কিলোমিটার রাস্তা। বালতালে ওই একই রকম গেট, চন্দনবাড়ির মতোই। গেটের বাইরেই শেয়ারে গাড়ি যাচ্ছে। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় সিন্ধুনদের পার ধরে ফিরে আসা। গাড়িতে তিন ঘণ্টায় নেমে এলাম শ্রীনগরে।
Leave a Reply