যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের এক দুরন্ত ছাত্রীকে ‘সবক’ শেখাতে গিয়েছিল হস্টেলের কিছু ছাত্র। খুব সম্ভবত, সেই সমঝে দেওয়া স্বাভাবিক নিয়মেই গড়িয়েছে শ্লীলতাহানির পর্যায়ে। যাদবপুর সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, অফিস, পাড়া, ঘর ইত্যাদিতে এরকম ঘটনা হামেশাই ঘটে। নিরানব্বইটি ঘটনাতেই কোনো প্রতিবাদ হয় না। এক্ষেত্রে ওই দুরন্ত ছাত্রী এবং তার দুরন্ত বন্ধু-বান্ধবীরা লাগাতার প্রতিবাদ চালিয়ে গেছে।
কয়েক বছর আগে থেকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝিলপাড় থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির লাগোয়া অনেক অংশে ছাত্রছাত্রীদের বসা বারণ হয়ে গেছে। রাত আটটার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোথাওই বসে থাকা যায় না। ছেলেদের দঙ্গলকে না তুললেও সেই দঙ্গলে যদি কোনো মেয়ে বসে থাকে অথবা কোনো ছেলেমেয়ে যদি পাশাপাশি বসে থাকে — তাদের তুলে দেওয়ার ব্যাপারে গার্ডদের তৎপরতা বেশি থাকে। প্রতিবাদ করলে গার্ডরা বলে, কর্তৃপক্ষের অর্ডার। শোনা যায়, ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কিছু শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের গায়ে গায়ে লেগে বসে প্রেম করা, ছাত্রীদের খোলাখুলি সিগারেট খাওয়া প্রভৃতিতে আপত্তি জানিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষের কাছে।
মেয়েটি লাজুক, বিনয়ী, নম্র, ভদ্র না হলে গা জ্বালা করে আরো অনেকের। অন্যান্য অনেক ভালো মন্দ ঐতিহ্যের মতো ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কতিপয় ছাত্রের কলা বিভাগের স্মার্ট ছাত্রীদের টোন টিটকিরি, গালাগালটাও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। হস্টেলের ছাত্রদের (যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের) নিজেদের মধ্যে আড্ডার সময় কলা বিভাগের অচেনা সপ্রতিভ ছাত্রীটিকে ‘মাগী’ বা ‘মাল’ বলে সম্বোধন করার রেওয়াজ ছিল। আজও আছে। আমাদের সমাজ থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা কিছু নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও দুরন্ত ছাত্রছাত্রীদের সবক শেখাতে চায়। কয়েক মাস আগেই কলা বিভাগের কিছু জায়গাতে দিনের বেলাতেও ছাত্রছাত্রীদের বসে থাকা, সিগারেট ইত্যাদি খাওয়া, গান বাজনা করা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেক্ষেত্রেও হস্টেলের কিছু ছাত্রই সন্ধ্যের পর দুরন্ত ছাত্রীদের ‘সবক’ শেখাতে গিয়েছিল। তার ফলশ্রুতিতে কর্তৃপক্ষ কিন্তু ওই ‘অভিভাবক’ ছাত্রদের কিছু বলেনি। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো আরও বড়ো অভিভাবক।
তবে তাদের চেয়েও বড়ো অভিভাবক পুলিশ, নেতা-মন্ত্রী, মিডিয়া। ছাত্রছাত্রীরা কী করবে আর কী করবে না তার লম্বা লিস্ট তাদের হাতে ধরা থাকে। সেই লিস্ট রোজ আরও লম্বা হয়। যেমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লিস্টে নতুন যোগ করেছে, ক্যাম্পাসে পুলিশ ক্যাম্প বসবে, টহল দেবে, নজরদারি রাখা হবে। বলা বাহুল্য, প্রয়োজনে হবে ধোলাই।
সেই ৩ সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদরত ছাত্রী ও ছাত্ররা এই অভ্যেসকে চাঁছাছোলা ভাষায় বলেছে, পিতৃতন্ত্র। তারা বলে দিয়েছে, আমরা আমাদের ভালোমন্দ বুঝি। আমাদের অভিভাবকের দরকার নেই।
Leave a Reply