শমীক সরকার, কলকাতা, ১১ মার্চ#
৫ মার্চ নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে কেন্দ্রীয় জেল থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণে অভিযুক্ত একজনকে প্রকাশ্য রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলেছে উন্মত্ত জনতা। নাগাল্যান্ডের ছাত্র সংগঠন (নাগা স্টুডেন্টস ফেডারেশন) -এর ডাকা এই কর্মসূচীতে সামনের সারিতে ছিল স্কুল কলেজের ছাত্রীরা। এই ঘটনা ঘটার সময় হাজির কয়েক হাজার মানুষের (বেশিরভাগই যুবক) তুলনায় কতিপয় প্রশাসনিক কর্মী কিছুই না। কিন্তু তারাই গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেছে একজন বিক্ষোভকারীকে, আহত আরো কয়েকজন।
ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম সৈয়দ ফরিদ খান। পেশায় গাড়ি ব্যবসায়ী। আসামের করিমগঞ্জ থেকে আট বছর আগে ডিমাপুরে এসে ব্যবসা করছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি এই ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়ে পুলিশের কাছে, ২৪ তারিখে গ্রেফতার হয় অভিযুক্ত। পরে তার জেল হেফাজত হয়। মিডিয়ার মাধ্যমে লোক জানাজানি হয় ঘটনাটি ঘটার বেশ কয়েকদিন পরে। মিডিয়া এবং সোস্যাল মিডিয়াতে ঘটনাটি এভাবে আসে, এক বাংলাদেশি বেআইনি অভিবাসী পুরুষ এক নাগা তরুণীকে ধর্ষণ করেছে।
১১ মার্চ নাগাল্যান্ড পুলিশ জানায়, মেয়েটির সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিল অভিযুক্ত। মেয়েটি একটি টিভি চ্যানেলে দাবি করেছিল, তাকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য ৫০০০ টাকা দিয়েছিল অভিযুক্ত। মেয়েটি অভিযুক্তের স্ত্রী (এক নাগা মহিলা)-র বান্ধবী। আরো জানা যায়, অভিযুক্ত বেআইনি বাংলাদেশি অভিবাসী নয়, ভারতীয় নাগরিক। তার বাপ দাদা-রা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মী ছিলেন।
আপাতদৃষ্টিতে ধর্ষণটি বড়ো বলে মনে হলেও, সমস্যাটির গভীরে রয়েছে এক বাংলাদেশি বেআইনি অভিবাসীর দ্বারা এক নাগা মহিলার ধর্ষণ। বেশ কয়েকবছর ধরেই উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে অসন্তোষ বেড়ে চলেছে বাংলদেশ থেকে বেআইনি অনুপ্রবেশ নিয়ে। অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানো নিয়ে আসাম সরকারের কিছু নির্দিষ্ট কর্মসূচী থাকলেও তা ঠিকমতো পালন হয় না। অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করাও শক্ত। এই নিয়ে আসামে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার স্মৃতি এখনও দগদগে।
নাগাল্যান্ডের মানুষ মনে করে, নাগাল্যান্ডে সমস্যাটি আরো তীব্র এবং এখানে কোনো ইনার লাইন পারমিটের ব্যাপার নেই, তাই যে কেউ এখানে এসে ব্যবসা খুলে বসতে পারে। ইনার লাইন পারমিটের দাবিও তোলা যাবে না (মণিপুরে অবশ্য কেউ কেউ তুলেছে) কারণ, এটা ব্রিটিশ রাজের ব্যাপার ছিল এবং ভারতীয় সংবিধান অনুসারে কোনো রাজ্যে ইনার লাইন পারমিট নতুন করে বসাতে পারা যাবে না। কিন্তু আসামে যেহেতু অবৈধ বাংলাদেশিদের বৈধ কাগজপত্র ঘুষ দিয়ে বানিয়ে নেওয়া যায় এবং যার ফলে অনুপ্রবেশকারী খুব সহজেই বৈধ ভারতীয় নাগরিক হয়ে উঠতে পারে, তাই ধরা যাক, আসামের করিমগঞ্জ থেকে কাগজপত্র বানিয়ে নিয়ে কেউ যদি নাগাল্যান্ডে চলে এসে ব্যবসা করতে শুরু করে, তাহলে তাকে কিছুতেই নাগাল্যান্ড প্রশাসন আটকাতে পারবে না। এভাবেই নাকি নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরের ব্যবসার জায়গাগুলো সব অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের হাতে চলে গেছে।
২০০৭ সালে নাগাল্যান্ডের মককচুঙ নামে একটি জায়গায় ‘সারভাইভাল মককচুঙ’ নামে একটি এনজিও সংগঠন এবং ছাত্র সংগঠনগুলি মিলিতভাবে মককচুঙ এলাকা থেকে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের চিহ্নিত করে বার করে দেয়। এই অভিযানের সাফল্যের কথা নাগাল্যান্ডের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। মূলত নাগাল্যান্ডের নাগরিক সমাজের মধ্যে মককচুঙ-এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এই অভিবাসী বাংলাদেশিদের তাড়ানোর ভাবনা গজিয়ে ওঠে। ফেসবুকে এই নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই কথা চালাচালি হতে থাকে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘সারভাইভাল নাগাল্যান্ড’ নামে একটি উদ্যোগ গজিয়ে ওঠে মককচুঙ-এর অভিজ্ঞতাকে নাগাল্যান্ডের অন্যান্য অংশে বাস্তবায়ন করার কর্মসূচী নিয়ে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি শক্তিশালী নাগা স্টুডেন্টস ফেডারেশন অবৈধ বাংলাদেশিদের প্রত্যক্ষভাবে চিহ্নিতকরণ ও বিতারণের কর্মসূচী হাতে নিয়ে নিলে নাগাল্যান্ডের আরো অনেক নাগরিক সংগঠন-ও এতে সামিল হয়ে যায়। প্রচার চলতে থাকে।
ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখের ধর্ষণের ঘটনাটি লোকজানাজানি হতে ৩ মার্চ নাগা ছাত্র সংগঠনটি মিছিল ডাকে, ‘ফের একবার বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীদের হাতে নাগা মেয়ের ধর্ষণ’ — এই বক্তব্যকে সামনে রেখে। তাতে বেশ লোক হয়। ৪ মার্চ হঠাৎ-ই ডিমাপুরের মেয়েদের কলেজ থেকে মেয়েরা বেরিয়ে এসে একটি মিছিল করে ডিমাপুরের পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষকর্তার ভবনের সামনে যায়। মিছিলটি ছোটো হয়ে শুরু হলেও প্রচুর মানুষ জুটে যায় পথে। সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত চলা এই সমাবেশ থেকে দাবি জানানো হয়, কিছুতেই যেন অভিযুক্ত জামিন না পায় তা দেখতে। এই সমাবেশ চলাকালীনই ডিমাপুরের ব্যাবসায়িক অঞ্চলে মুসলিম ট্রেডারদের দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়। আন্দোলনকারীরা দাবি করে, ওগুলো বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীদের ব্যবসা। প্রশাসন কার্ফু জারি করে। পরদিন সকাল সাতটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত কার্ফু শিথিল ছিল। সেই সময় নাগা ছাত্র ফেডারেশন মিছিলের ডাক দেয়। কলেজ ও স্কুল পড়ুয়া মেয়েরা ছিল এই মিছিলের পুরোভাগে। মিছিলটি প্রায় সাত আট কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে ডিমাপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে অভিযুক্তকে ভেঙে বের করে আনে। পুলিশ তখন লাঠি ও শূণ্যে গুলি চালালে ছাত্রীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও তখন কর্মসূচীটির দখল নিয়ে নিয়েছে যুবকরা। গোটা ঘটনাটিতে মিডিয়া এবং ফেসবুক প্রভৃতি সামাজিক মিডিয়া অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করে। অবশ্য, অবৈধ বাংলাদেশি বিতাড়নের প্রচার কয়েক বছর ধরে নাগাল্যান্ডের মিডিয়াতে জায়গা করে নিয়েছিল।
ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নাগাল্যান্ড প্রশাসন পরদিন থেকে অনির্দিষ্টকালীন কার্ফু জারি রাখে। ৭ মার্চ রাত থেকে গোটা নাগাল্যান্ডে ইন্টারনেট ও মোবাইলে এসএমএস সার্ভিস নিষিদ্ধ করে দেয় প্রশাসন। ঘটনার জন্য প্রায় পঞ্চাশজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ ও ডিমাপুর সেন্ট্রাল জেল-এর শীর্ষস্থানীয় প্রশাসকরা সাসপেন্ড হয়ে যায়। নাগাল্যান্ড থেকে প্রায় ৪০০০ বাংলাভাষী পালিয়ে যায় আক্রমণের ভয়ে।
Leave a Reply