আমাদের লোককথায় দুর্গা ছিলেন নিরাভরন অর্থাৎ অলঙ্কারহীন এক বধূ। পতি মহাদেবের কাছে তিনি বিনতি করছেন, বাপের বাড়ি যাবেন, তাঁর পায়ে পড়ছেন, ‘আমাকে যেতে দাও’। যেন এক গ্রাম্যবধূ স্বামী আর সংসারের কর্তৃত্বে বাঁধা পড়ে সাময়িক মুক্তি চাইছেন, আপাতত বাপের বাড়ি সেই মুক্তিস্থল, ক-দিনের জন্য হাঁফ ছেড়ে বাঁচা!
কিন্তু কর্পোরেট ক্ষমতা আর লোভের প্রতীক-স্বরূপা দুর্গা এখন মোটেই নিরাভরণ নয়, আপাদমস্তক আভরণ বা অলঙ্কারে বন্দি। তাঁর সাজ-সজ্জা এখন মধ্যবিত্ত ঠাঁটবাটের কামনাকে জাগিয়ে তোলে। দেবী দুর্গা এখন কর্পোরেট বাণিজ্যের বিজ্ঞাপনের সামগ্রী মাত্র। পুজো কমিটির কর্তা দেমাক করে, ‘এক কোটি টাকার পুজো করেছি’!
এইরকম পুজোর মডেলকে যখন কলকাতা থেকে মফস্বল মায় গ্রাম পর্যন্ত সকলে অনুকরণ করতে ব্যস্ত, তখন কলকাতার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে গঙ্গার তট ঘেঁষে মহেশতলার আকড়া পুরাতন বাজার অঞ্চলে ইটভাটার সামনে আমরা দেখতে পাই এক ভিন্ন ধরনের পুজোর আয়োজন।
নিজেরা খাটাখাটুনি করে পূজা মণ্ডপ দাঁড় করিয়েছি
২৩ অক্টোম্বর, দীপঙ্কর গায়েন, মিস্ত্রিপাড়া, আকড়া পুরাতন বাজার
জাগ্রত সংঘের পরিচালনায় এই যে পূজা মণ্ডপ হয়েছে, সেটা আমরা সকলে খাটাখাটুনি করে দাঁড় করিয়েছি। অক্লান্ত পরিশ্রমে মাসখানেক দিনে-রাতে কাজ করে আমরা এটা সম্পূর্ণ করেছি। আমরা সাত-আটজন আছি, কেউ দিনে খেটেছি, যারা দিনে সময় পাইনি রাতে কিংবা ভোরে কাজ করে এটা কমপ্লিট করেছি। লেবার প্রায় সবটাই আমরা নিজেরা দিয়েছি। এছাড়া নিজেরা গিয়ে বাইরে থেকে খড়, বস্তা, বাঁশ জোগাড় করে এনেছি। বাঁশ কিছু আমরা মেম্বাররা দিয়েছি, কিছু লোকের ঝাড় থেকেও কেটেছি। আমরা এইটুকু এলাকা নিয়ে পূজা করি, যাতে আমাদের বাজেট বেড়ে না যায়, যত কম বাজেটে যত সুন্দর ভাবে পূজাটা করা যায়। জাগ্রত সংঘ মিস্ত্রিপাড়ার ক্লাব, পাশে বাছাড়পাড়া। এখান থেকেই কালেকশন হয়েছে। প্রতিমা আর মডেল নিয়ে মোট কুড়িখানা মূর্তি আছে, এর জন্য খরচ লেগেছে।
এখানে আমরা সাঁইত্রিশ বছর ধরে পূজা করে আসছি। এর আগে আমাদের বড়োরা পূজাটা করে এসেছে। এখন তাঁদের বয়স হয়ে গেছে, অনেকে মারাও গেছে। সেখানে আমরা জুনিয়র ছেলেরা দু-তিন বছর হল দায়িত্ব নিয়েছি। এবারে এই পূজার থিমের চিন্তাটা সম্পূর্ণ প্রদীপ নস্করের। তিনি থাকেন ময়নাগড় আশুতি অঞ্চলে। তাঁর সঙ্গে আমাদের ছেলেরা দিনরাত খেটে এটাকে রূপ দিয়েছি। আমরা চার-পাঁচ বছর আগে সিনারি করছিলাম। যেমন, বোর্ডের ওপর আঁকা পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দির। তারপর এখন আমরা গত কয়েক বছর থিম করছি। রবীন্দ্রনগর থানা এলাকায় আমরা প্রাইজও পেয়েছি। এছাড়া মণ্ডপ সজ্জায় রয়েছে এস এম ডেকরেটার্স। এর প্রোপ্রাইটর শ্যামল মিস্ত্রি, আমাদের ক্লাবেরই মেম্বার। পুরাতন ডাকঘরের কমল বাছাড় প্রতিমা শিল্পী। তিনিই মাটির মডেলগুলো তৈরি করেছেন।
Leave a Reply