অমিতাভ সেন, ১৪ জানুয়ারি#
এই স্টেশনের নাম কী?
আমার প্রশ্নের উত্তরে ‘পিয়ালি’ বলে কমলা-সাদা চুড়িদার আর জলরঙা উড়নি পরা যে কিশোরী কাঁধে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে নেমে গেল তার মুখ দেখলে বোঝা যায় তার নামেই স্টেশনটির নাম।
এর দুই স্টেশন পরেই ঘুটিয়ারী শরিফ। সেখানে পীরের দরগা দেখাব আর তারপর ক্যানিং-এ গিয়ে মাতলা নদী দেখাব বলে বউকে নিয়ে বেড়িয়েছি — একথা জেনে আমার সহযাত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাচার কি মানত করা আছে’? আমার লম্বা সাদা দাড়িতে তিনি আমায় মুসলমান ঠাউরেছিলেন। ‘না, এমনি ঘুরতে যাচ্ছি’ বলে আমরা উঠে আসায় তিনি বিভ্রান্ত হয়ে বসে রইলেন।
তিরিশ বছরে অনেক কিছুই পালটে যাওয়ার কথা। কিন্তু এতটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। বউকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম — এরকম নয় — তখন এমন মসৃণ গম্বুজ ঘিরে এরকম বাহারি মিনারের পাহারা ছিল না, জানাজা করার জন্য ধুনো জ্বালালে তার ধোঁয়া উড়ে আসমানে চলে যেত, মাথার ওপর ঝুঁকে পড়া খিলানের এত রঙীন কারুকাজে আটকাত না, এত চকচকে নিষেধের পাথরে বাঁধানো ছিল না অজু করার পুকুর। এখন যে এই মাজারের চত্বর ঘিরে এত লোকের দোয়া মাঙানোর জন্য এত হাঁকাহাঁকি ফল-ফুল কেনানোর জন্য এত সাধাসাধি, এত বাজার-দোকান, এত ভাড়া দেওয়ার ঘর বাড়ি — ওই যে মহিলার ফিসফিস স্বরে ডাক ‘এসো, ভালো ঘর আছে’ — এসবের জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।
এইখানে গাজীবাবার ধূসর সমাধি ঘিরে শান্তির একখানা ছবি ছিল। তার ছিটেফোঁটাও খুঁজে না পেয়ে স্টেশনে ফিরে এসে আমরা উদাসীন হয়ে পরের ট্রেনে ক্যানিং যাওয়ার জন্য চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে দেখি টিকিট ঘরের পাশে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে নাচের স্কুলের নাম — ইংরেজিতে লেখা আছে ‘তাণ্ডব’। তাই দেখে সকরুণ এক হাসি মুখে নিয়ে পরের ট্রেনে চেপে ক্যানিংয়ে নেমে সে হাসি মুছে যেতে বেশি সময় লাগেনি।
ক্যানিং বাজারের মধ্যে গিয়ে সেই ইঁটের বাঁধানো রাস্তাটা হারিয়ে ফেললাম, যেটা ধরে তিরিশ বছর আগে আমি বন্ধুর সঙ্গে মাতলার ২নং লঞ্চ ঘাটে পৌঁছেছিলাম। তারপর একে একে হারাতে লাগলাম লঞ্চঘাট, জেটি, লঞ্চ, নৌকা, মাঝি-মাল্লা এমনকী গোটা নদীটাই। কোথায় উত্তাল নদী, ঢেউয়ের চূড়ায় ফেলা, কালো জলের গভীরে কামটের বিপদ, খেয়া পারাপারের গা ছমছম ভয় আর ফেরীলঞ্চের গম্ভীর গোঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ন্ত গাঙচিলের তীক্ষ্ণ শিস। চারিদিকে এখন শুধু বালির চরা, তার ওপর বড়ো বড়ো বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে, কংক্রীটের দীর্ঘ সেতুর উপর দিয়ে সাঁ-সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে বাস, মোটরগাড়ি, অটো — তাদের ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে গেছে ঝড়ে-বন্যায় পালিয়ে যাওয়া দ্বীপবাসীর পায়ের ধুলো …. ব্রিজের নিচে পড়ে আছে উল্টোনো ডিঙির শব আর মাতলার জন্য দু ফোঁটা চোখের জল।
উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে এসে ফেরার ট্রেন ধরার প্ল্যাটফর্মে বসে আছি। রেল কোম্পানির রেলিঙের ওধারে আমাদের দিকে পিছন ফিরে এক মিশমিশে কালো জোয়ান সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে বসে আছে — তার এক হাত ধরে এক বৃদ্ধা মহিলা টানছেন — মহিলার অন্য হাতে একটা বাখারি, পরনে সবুজ পাড়ের সাদা কাপড় — সে কিছুতেই উঠবে না — তাদের ঘিরে কাছে দূরে অনেক দর্শক — এপাশের স্টেশনের হকাররা বলাবলি করছে — ও রাজুর ভাই, চিনতে পারছিস না, হ্যাঁ, এই তো কিছুদিন আগেও তো দেখেছি ভ্যান চালাত, একদম পাগল হয়ে গেছে, কেউ বোধহয় কিছু খাইয়ে দিয়েছে। পাগলকে তখন সেই বৃদ্ধা বাখারি দিয়ে মারছেন, হঠাৎ সে রেগে গিয়ে বৃদ্ধার হাতের বাখারি কেড়ে নিয়ে দূরে ফেলে দিল, আর তাঁর কাপড় টেনে অর্ধেক খুলে দিল। বৃদ্ধা তখন নিজের কাপড় আবার ঠিক করে নিয়ে পাগলের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন — এবার সে খানিক শান্ত হয়ে মহিলার হাত ধরে ওপাশের লাইনের ধারে ঝোপঝাড় টপকে চলে গেল।
আমরাও চলে যাচ্ছি। ভক্তির বাজার ঘিরে অত মাছির ওড়াউড়ি আর নদীর হত্যাকান্ড দেখতে এদিকে আর আসব না। কোথায় যাব তাও জানি না। মানুষের নির্মম ইতিহাস পৃথিবীর সবটা ভূগোল বিশ্রীভাবে পাল্টে দিয়েছে। আপাতত ঘরে দরজা এঁটে বসে থাকা অনেক স্বস্তিকর।
poromesh acharya says
Lekhata pore manta kharap hoe galo. Lkhak trish bachart ager smriti khuje pannio. Ami Matla nadir sange parichoy korechilm shat bachar age. janina kemon lagto ekhon abar sekhane gale. Sumndarbaner onek amnchalei ekoda onek ghurechi, dekhechi, kichudin hasnabader dakshine ekta grame kichudin mastrari o korechi. mone porche gramta bodhoy Barunhat. Lekhaker bibaran pore mone holo bhaggis abar phire dekhar chesta korini. Ei ashitipar jibane abhignata to kom holona. Ami to Kolkata kei ar chinte parina. Lkhak ke dhanyobad. poromesh acharya.