সঞ্জয় ঘোষ, জয়নগর, ২৪ আগস্ট#
জয়নগর মজিলপুর পৌরসভা অঞ্চলের পশ্চিম প্রান্তে মিত্রপাড়া বা রাধাবল্লভতলা দিয়ে আরো কিছুটা এগোলেই শুরু হল দূর্গাপুর পঞ্চায়েত অঞ্চলভুক্ত শসাপাড়া। এদিকে শসাপাড়া থেকে শুরু করে পরপর বেশ কয়েকটা গ্রামে রাজবংশী তীয়র সম্প্রদায়ের মানুষরা বাস করেন। এদিকটায় জয়নগর থেকে আদিগঙ্গার লুপ্ত হয়ে যাওয়া ধারার সঙ্গে যুক্ত খালের ঠিক পাশ ধরে ইটের পায়ে হাঁটা রাস্তা, যার দু-পাশে ধানক্ষেত সব্জিবাগান পুকুর গাছপালা — উন্মুক্ত প্রকৃতি।
শসাপাড়া গ্রামে ঢোকার কিছু পরেই দেখা হল চরণ কাঁজির(৩০) সাথে। অতিবৃষ্টির পরে চাষের অবস্থা কিরকম? জিঞ্জাসা করতেই ও আমাকে যা যা বলল ও দেখাল, তা আমার ভাষায় নিচে উল্লেখ করছি। প্রথমে ও নিয়ে গেল মোবাইল টাওয়ারের পাশে একটা জমি দেখাতে। চরণের কথা অনুযায়ী এটা ওর মামা রাম ঘুঘু(৪০-৪২)-র ১০ কাঠা জমি, যাতে গত পঞ্চায়েত থেকে বিনা পয়সায় গ্রামের কিছু লোককে দেওয়া হাইব্রিড স্বর্ণপঙ্কজ ধান রোয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘কেটে গেছে’, মানে একদমই হয়নি (ছবি ১)। চরণ জানাল, বর্ষার আগে পঞ্চায়েত থেকে সে ১৫ কেজি স্বর্ণপঙ্কজ ধানের বীজ পেয়েছিল। চরণ এসইউসি দলের সমর্থক, এবং গত পঞ্চায়েত বোর্ড এসইউসি দলেরই ছিল। প্রধান আয়েন আলি ওকে বীজ দিয়েছিলেন। বিডিও থেকে লোক এসে গ্রামে সভা করে বলেছিল, তিন ফুট জলেও স্বর্ণপঙ্কজ ধান চাষ করে ভাল ফসল পাওয়া যাবে। কিন্তু চরণের কথা অনুযায়ী, আড়াই ফুট জলেই ওর নিজের জমিতে ওই স্বর্ণপঙ্কজ ধানের অবস্থা না হবারই মত (ছবি ২)। ও জানাল, ২ বিঘা জমিতে এই ধান লাগিয়েছে, তার থেকে ১৭ বস্তা (ওর মতে, এক বস্তা নাকি ৭৪ কেজি) ধান ও আশা করেছিল। এখন মালিকই ভরসা।
পাশ দিয়ে একজন মাঝবয়সী চাষি যাচ্ছিলেন। আমি তাকে ডেকে জিঞ্জাসা করলাম, দাদা এই জমিতে কিরকম ধান হবে বলে মনে হচ্ছে? তিনি দেখে বললেন ১৪ বস্তা হত কিন্তু এখন যা অবস্থা পাঁচ কেজি থেকে বড়জোর ২০ কেজি হতে পারে, বীজধানটা হয়ে যাবে। কিন্তু ও দেখাল, ঠিক বাঁ পাশেই নূর আলি দেশি সাদা মোটা ধান লাগিয়েছিলেন। মাত্র ২০-২২ দিন আগে ওই ধান লাগানো হয়, কিন্তু ওর নিজের জমিতে আষাঢ় মাসের ২২-২৪ তারিখে মানে ৪৫-৪৭ দিন আগে লাগানো ধান গাছের চেয়ে লম্বা আর গোছও ভাল হয়েছে (ছবি ২ ও ৩)। আর এক জায়গায় ও দেখাল, দেশি সাদা মোটা ধান একইরকম ভাল হয়েছে। কিন্তু পাশেই পুরো আলের ওপর অনেক শসা গাছ এবং সেগুলোতে কিছুই হবেনা বলে জানাল। দেখলাম গাছের পাতাগুলো হলদেটে বা কালচে লাল হয়ে শুকিয়ে গেছে (ছবি ৩)।
আমরা এতক্ষণ জয়নগর থানা অঞ্চলের মধ্যে ছিলাম। এবার চরণ আরো পশ্চিমে যেখানে নিয়ে গেল, সেটা মগরাহাট থানার ঈশ্বরিপুর গ্রামের অঞ্চলের বলে জানা গেল। ও বলল, ভাগটা হয়েছে মোটামুটি ওপরের হাই টেনশন ইলেকট্রিক লাইন বরাবর। তবে এখানে লোকালয় নেই, শুধুই খেত। আসল ইশ্বরীপুর গ্রাম আরো দূরে, খালের ওপর পাকা ব্রিজ পেরিয়ে যেতে হয়। এইখানে চরণ শোলা চাষ করেছে প্রায় এক বিঘা জমিতে (ছবি ৪), জলের ওপর চার ছয় ইঞ্চি মাথা তুলেছে গাছ। এখানে ওর মতে, ফুট তিনেক জল। শোলা কিন্তু ৬-৭ ফুট জলেও ভাল হয়, তাই এদিকে বেশ কিছু জমিতে শোলা চাষ হয়েছে দেখলাম। চরণ জানাল, ওরা দুই ভাই বাবা মা দুই ভাই-বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে ১৭ জনের সংসার, মোট ৭ বিঘে জমি ওদের। সাড়ে তিন বিঘে নিচু জমিতে চাষ করতে পারেনি জল জমায়। কিছু জমিতে দুধেশ্বর (দেশি সুগন্ধী সরু ধান) লাগিয়েছে, সেটা নাকি হয়েছে। এটা ও বাজারে বিক্রি করবে বেশি দামের ধান বলে। কম দামের ধান ওরা নিজেদের সারা বছরের খাবার জন্য রাখে।
ফেরার পথে একটা পুকুরের পাশে বেশ কিছু হাঁস আর হাঁসা দেখিয়ে চরণ বলল, মনসা পূজায় বিক্রি হবে ২৫০ টাকায় একটা হাঁসা। আমার মনে পড়ল, ভাদ্র সংক্রান্তির মনসা পূজায় সারা সুন্দরবন অঞ্চলে মনসা দেবীর উদ্দেশে কিরকম হাঁসা বলি হয় সেই সব কথা। বলা দরকার, গ্রামে ঢোকা থেকে ফেরা পর্যন্ত রাস্তার পাশে খালের দুপাশে প্রচুর লোককে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে দেখেছি। এক মহিলাকেও দেখেছি, বাচ্চাদেরও হাতে ছিপ নিয়ে ঘুরতে দেখেছি। বৃদ্ধদেরও দেখেছি ঘুনি আটল থেকে মাছ সংগ্রহ করার জন্য গলা জলে ডুব দিতে বা সাঁতার কাটতে। আসলে এখন জল জমায় ক্ষেতের কাজ নেই। তাই খাওয়ার জন্য সরকারি খাল থেকে মাছ সংগ্রহই একমাত্র কাজ।
Leave a Reply