তমাল ভৌমিক, ভবানীপুর, ১০ জুলাই #
জগুবাজার বাসস্টপের উল্টোদিকের ফুটপাথে লালুর চায়ের দোকানে অটলের সাথে দেখা। সে ঘুগনি রুটি খাচ্ছে। আমাকে বলল, টিফিন খাচ্ছি। আমি বললাম এত বেলায়! সকাল থেকে খালি পেট? তোমায় না গ্যাসট্রিকের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। অটল বলে, না দাদা, সকালের দিকে একবার ১০০ গ্রাম ছাতুর শরবৎ খেয়েছি। তাছাড়া মাঝেমাঝে দুধছাড়া চা, সুগার আছে তো; আলাউদ্দিনেরও আছে। আলাউদ্দিনের মুখোমুখি বসে ভবানীপুরের যদুবাবুর বাজার, সংক্ষেপে জগুবাজারে মাছ বেচে অটল। অটল সর্দার, বয়স ৫০ পেরিয়েছে। বেলা পৌনে বারোটা। এখন সাইকেল চালিয়ে সে যাবে জুলপিয়া থেকে আরও ২ কিমি ভেতরে কৃষ্ণনগর গ্রামে। এখান থেকে ২ ঘন্টা সময় লাগবে যেতে। সকালে আসার সময় সে কবরডাঙ্গা থেকে মাছ তোলে। ওখানে পাইকারি বাজারে মাছ আসে ডায়মন্ড হারবার থেকে, মালঞ্চ থেকে এমনকী দীঘা থেকেও। সাত-আটটা ব্যাগে পাঁচ-ছ রকম মাছ, ২০ থেকে ৩০ কিলো, রোজ আনে। সবরকম মাছে সমান লাভ থাকে না। ঘরে ১০ থেকে ১৫ টাকা কিলোতে লাভ — চিংড়িতে একটু বেশি, পোনামাছে সবচেয়ে কম। রোজ সব মাছ বিক্রি হয় না। বাকি মাছ বাজারে বরফ চাপা দিয়ে রাখার ব্যবস্থা আছে। বরফের জন্য রোজ ৪০-৫০ টাকা খরচ হয়। দৈনিক ভাড়া ৬টাকা ৭৫পয়সা। বাজার সমিতিকে ২টাকা করে রোজ অটলকে দিতে হয় নিজের বসার জায়গাটুকুর জন্য। অটল নিচে বসে। আর মাছের বাজারের উঁচু রকে অটলের দাদুর আমলের একটা জায়গা আছে। সেখানেই প্রথম দাদুর সাথে মাছ বেচতে এসেছিল ১৯৭০ সালে — তখন সে সবে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছে। সেই জায়গাটায় এখন কেউ বসে না, যদিও অটলকে তার জন্যে একই হারে ৬ টাকা ৭৫ পয়সা করে দৈনিক দিতে হয়। আর তাছাড়া এই দুটো জায়গায় মাছ বিক্রির লাইসেন্স ফী বাবদ বছরে ৫৫০ টাকা করে দিতে হয়।
তবু অটল জায়গাটা বেচবে না। ঘুগনিতে পাঁউরুটি ডুবিয়ে সে আমায় বলে, বুঝলেন দাদা, দাদুর স্মৃতি তাই রেখে দিয়েছি। আমি বললাম, পরে কোন কাজে লাগতেও পারে। অটল মাথা নাড়ে, নাঃ, ছেলেকে বলেছিলাম, সে বলেছে মাছের ব্যবসা করবে না। আমার ভাই পাঁচু যে আমার পাশে বসে মাছ কাটে ওরও তো নিজের জায়গা ওটা। কিন্ত জগুবাজারে মাছ বিক্রি অনেক কমে গেছে। এখানে সব নন-বেঙ্গলি ব্যবসায়ী এসে পুরোনো বাড়িভাঙ্গা-ফ্ল্যাটগুলো দখল করেছে। তারা আবার মাছ খায় না। ছেলেকে তাই অটো কিনে দিয়েছে অটল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে ছেলে আর কিছু কাজ পেল না। এখন সে ছেলে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা আর বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত অটো চালিয়ে দিনে ২৫০-৩০০ টাকা ইনকাম করে। তবে বেশিদিন করবে না। ওদের ওখানে স্টুডিয়ো (সিনেমার শুটিং-এর) যে জায়গায় তৈরি হচ্ছে তার পাশে অটলের জমি রাখা আছে, ইচ্ছে আছে সেখানে ছেলের জন্য একটা দোকান করে দেবে।
গল্প করতে করতে অটল বলে – বিঘে তিনেক জমি আছে আমাদের – বাবা কাকাদের একসঙ্গে পরিবার। কাকারা দুজন চাকরি করত একজন রিটায়ার্ড, একজন এখনও খিদিরপুর ডকে কাজ করে। ওই জমির ধানে আমাদের সারাবছর চলে যায়। কিছু তরকারিও লাগিয়েছি — পুঁইশাক, নটেশাক। এইতো এখন টিফিন খেলাম। বাড়ি পৌঁছাবো আড়াইটের পরে। তারপর খেয়েদেয়ে বিকেলে মাঠে গিয়ে কোদাল মারব। তরকারী আমাদের কিনতে হয় না। এতেই কোনরকম চলে যাচ্ছে। হাই-ফাই লোকেদের সাথে মিশি না। মাঝারি মাপের লোকেদের সঙ্গে ওঠা-বসা। একদিন চলুন না দাদা।
আমি জানি, অটল আগে খুব বাংলা খেত। সন্ধ্যাবেলা তো বটেই, সকালেও মাছ বেচতে বেচতে মুড়ির সঙ্গে প্লাস্টিকের জলের বোতলে বাংলা খেতে খেতেই ওর সাংঘাতিক পেটের রোগ হয়েছিল। মাসখানেক হাসপাতালে কাটিয়ে এখন বোধহয় ছেড়ে দিয়েছে মদ খাওয়া। জিজ্ঞাসা করি — সন্ধ্যাবেলা কী করো অটল? বলল, তরকারি বাগান থেকে ফিরে টিভি দেখি। রাত ৯টা অবধি। তারপর খেয়েদেয়ে শুতে রাত ১০ টা। আবার ভোরবেলা সাড়ে তিনটেয় রেডি হয়ে সাইকেল নিয়ে বেরোতে হয়। আজকাল অবশ্য খুব মুশকিল হয়েছে। দুঘন্টা-দুঘন্টা সাইকেল চালিয়ে শহরের উপকণ্ঠ থেকে এসে মাছের ব্যবসা করে অটল ম্যাটাডোরের আশি টাকা ভাড়া বাঁচাত। কিন্তু ইদানীং পুলিশ খুব ঝামেলা করছে। অটল বলে – কদিন আগে এই তো রাসবিহারীর কাছে রাস্তার ওপারে যাব। টিফিন খাওয়া হয়নি। ওখানটায় চাউমিন বিক্রি করছে। ভাবলাম হাফ-প্লেট চাউমিন খাব। হঠাৎ পুলিশ এসে ধরল। ১০০ টাকা ফাইন দিতে হবে। আঙ্গুল তুলে দেখালো রাস্তার ধারে বোর্ডে লেখা আছে সাইকেল চালানো নিষেধ। আমি বললাম — এত সব মালপত্তর বোঝা নিয়ে সাইকেল চালাচ্ছি; আমি কি রাস্তা দেখব না সাইনবোর্ড দেখব — অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাবে না? কোনো কথা শুনবে না। একশো টাকা দিতে হবে। আমি বললাম — এই দেখুন আজ একশো তিরিশ টাকা লাভ হয়েছে, মাছের কাঁটা আর আলু কিনেছি, ব্যাগে আছে দেখুন, আপনাকে একশো টাকা দিলে হাতে কী থাকবে? কোনো কথা শুনল না, একশো টাকা নিয়ে ছাড়ল। আমি হচ্ছি গিয়ে ধরা পড়াদের মধ্যে ৫০ নম্বর, ৫০ নম্বর লেখা কাগজ দিল। এর আগে ধরা পড়া ৪৯ জনের দু-একজনকে চিনি — মাছের আঁশপাশ কুড়ায় জগুবাজারে। তাদের অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ। একশো টাকাও দিতে পারল না, শেষে বাড়িতে ফোন করল টাকা পাঠানোর জন্য।
দুঃখের গল্প শেষ হওয়ার পর সুখের গল্প। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে। দোকানের তেরপলের তলায় দাঁড়িয়ে অটল আমায় খবর দিতে থাকে — ওর মেয়েটা ভালো, একটা ছেলের পর একটাই মেয়ে, ক্লাস টেন থেকে ইলেভেনে উঠেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য খবর — অটল কুড়ি বছর তবলা শিখেছে। এখন ও নিজের বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা সাত-আটজনকে তবলা শেখায়। তাতেও কিছু ইনকাম হয়। মেয়েকেও কিছুদিন গান শিখিয়েছিল, এখন পড়ার চাপে গান সে বন্ধ রেখেছে। ছেলেও নাকি স্কুলে গিয়ে বেঞ্চি বাজাত। মানে ওদের পরিবারে সংগীতের রেওয়াজ আছে। বৃষ্টি কিছু ধরে আসায় উঠব উঠব করছি, বললাম অটল তোমার ছাতা আছে? অটল বলল, না দাদা, ছাতা হাতে সাইকেল চালানো যায় না। তাছাড়া সঙ্গে মাছের থলে থাকে। অতখানি রাস্তা একহাতে চালানো যায়? আমি ভিজেভিজেই যাতায়াত করি, অসুবিধা হয় না। শুধু বেশি গরমে একটু কষ্ট। আমি তখন উঠে আসছি, অটল সমানে বলে যাচ্ছে, যাবেন কিন্তু দাদা বৌদিকে নিয়ে, একটা ছুটির দিন দেখে, বাজারের কাউকে বলতে হবে না, সব তো শিক্ষার ঢিপি, খিস্তি ছাড়া কথা জানে না। আমি একটু হেসে ফিরে আসতে আসতে ভাবছি, বহুদিন হল অটলের থেকে মাছ কিনি না। ওর একটু ওজনে মারার স্বভাব আছে। বাজারের যে দিক দিয়ে ঢুকি তার মুখে অটল বসে। রোজই ডাকে। কিন্তু আমি কখনো পাত্তা দিই না। অথচ আমাকে ওর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করায় আন্তরিকতার কোনো অভাব তো নজরে পড়ল না। লজ্জা পাব কি?
Leave a Reply