ডায়ানিউক ডট অর্গ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বয়ান অনুসরণে, সম্পাদনা ও অনুবাদ শমীক সরকার, ১১ সেপ্টেম্বর। ৯ সেপ্টেম্বর থেকে চলা আন্দোলনের সরাসরি খবর এখানে#
১০ সেপ্টেম্বর সকালেই সশস্ত্র পুলিশ চলে আসে আন্দোলনকারীদের নাকের ডগায় এনং সকাল ১০.৩০ নাগাদ একদফা লাঠিচার্জ শুরু করে। কিছুটা ধস্তাধস্তি হওয়ার পর পুলিশ সংবরণ করে। কিন্তু ব্যাটনধারী পুলিশের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যায় দাঙ্গা-পুলিশ এবং টিয়ার গ্যাসের শেল নিয়ে পেছনে দাঁড়ায় আর একদল।
এর কিছু পরে দু’জন যুবক একটা ফাইবারের নৌকা নিয়ে সমুদ্র দিয়ে কুদানকুলাম পরমাণু প্রকল্পের দিকে এগিয়েযায়। আন্দোলনকারীরা এর বিরুদ্ধে, তাই তারা পুলিশের অনুমতি নিয়ে ওই দু’জনকে ধরে ফেলে এবং তাদের নিরস্ত করে ও তাদের আন্দোলনের জায়গায় ফিরিয়ে আনে। কিন্তু তিরুনেলভেলির পুলিশ সুপারের আদেশে ওই দুই যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। আন্দোলনকারীরা এই গ্রেফতারের প্রতিবাদ করে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই সময় ১১.৩০ নাগাদ ওই পুলিশ সুপার বিজয়েন্দ্র বিদারি আদেশ দেয়, দশ মিনিটের মধ্যে প্রতিবাদকারীদের জায়গা খালি করে দিতে হবে, নচেত পুলিশ তাদের অ্যাকশন শুরু করবে।
মেয়েরা কুদানকুলাম চুল্লির দিকে প্রথম ব্যারিকেড লাইন তৈরি করে। বাচ্চারা এবং পুরুষেরা সমুদ্রের তীর বরাবর লাইন করে দাঁড়িয়ে যায়, কুদানকুলাম প্রকল্প থেকে ইদিনথাকারাই গ্রাম বরাবর। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের ডিআইজি রাজেশ দাস পুলিশকে আদেশ দেয়, ব্যারিকেডের মাঝখানে চলে যেতে, যাতে পুরুষ এবং মহিলা আলাদা করে ফেলা যায়। টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারের মধ্যে দিয়ে মানুষ দেখতে পায়, ১০ মিনিট সময়সীমা শুরু হতে না হতেই পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে শুরু করে। একজন আন্দোলনকারীর বয়ান,
একজন পুলিশ দুইজন যুবক স্বেচ্ছাসেবীকে ধাক্কা দিয়েছে এই নিয়ে একটি ধস্তাধস্তি শুরু হয়। কয়েকজন মহিলা পুলিশকে চিৎকার করে কিছু বলতে থাকে এবং তাদের কেন্দ্র করে অনেক আন্দোলনকারী জড়ো হয়ে যায়। তখন সেখানে কিছু পুলিশ ছুটে যায় এবং লাঠি চালাতে শুরু করে। আমরা কিছু বোঝার আগেই আমাদের মধ্যেখানে কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে পড়ে।
আমরা টিভিতে দেখতে পায়, বিশালসংখ্যক পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং লাঠি চালাচ্ছে। এই পুলিশের লাঠি এবং সমুদ্রের মাঝখানে পড়ে গিয়ে মেয়েরা এবং অন্যান্যরা সমুদ্রের বালি তুলে নিয়ে পুলিশের দিকে ছুঁড়তে থাকে তাদের লাঠির আঘাত প্রতিহত করার জন্য। অনেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়। ক্যামেরায় দেখা যায়, র্যাফ তাদের দিকে চটি, লাঠি এবং পাথর ছুঁড়ছে। পুলিশ শাসাতে থাকে, পাড়ে এলেই তোরা মরবি। একসময় একজন যুবকের হাতে মোবাইল দেখে এক পুলিশকর্মী চিৎকার করে ওঠে, ওই দ্যাখ, হাতে বোমা। আরেকজন পুলিশটিকে গিয়ে বলে, না না, ওটা মোবাইল।
আন্দোলনের এক নেতা এবং স্থানীয় কাউন্সিলর সহায় ইনিথাকে পুলিশ টার্গেট করে পেটায়। সে গুরুতর আহত। উদয়কুমার একটি টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, তার দিকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি চালিয়েছে, মাথা নিচু করে নেওয়াতে তিনি বেঁচে গেছেন। আশেপাশে যারা ছিল, তারা এটা সমর্থন করে — উদয়কুমার যখন একটি ফাইবার বোটে চেপে ওই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, তখন তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় পুলিশ।
বেশ কিছু মিডিয়ার লোক পুলিশের হাতে আহত হয়। টাইমস নাউ-এর এক সাংবাদিককে টার্গেট করে পেটায় পুলিশ।
এদিকে সমুদ্রের ধারে একদল পুলিশ যখন এই ঘটনা ঘটাচ্ছিল, তখন আরেকদল আন্দোলনকারীরা যেসব গাড়িতে করে এসেছিল, সেগুলো ভণঙতে থাকে। সেটা ভিডিওতে তুলছিল টাইমস নাউ পত্রিকার এক সাংবাদিক। পুলিশ তাকে বেধরক মারে, তার ভ্রুর ওপরে চারটে সেলাই দিতে হয়েছে। তার ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলা হয় ও সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়, এবং ভিডিওটেপটি নষ্ঠ করে ফেলা হয় বলে জানা গেছে। শোনা যাচ্ছে, মিডিয়ার লোকের ব্যবহার করা তিনটে মোটরসাইকেল পুলিশি আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দিনাকরণ পত্রিকার এক সাংবাদিককে ধাক্কা দেওয়া হয়, এবং মাক্কাল টিভির এক সাংবাদিককে ঝোপে ফেলে দেওয়া হয়।
আন্দোলনকারীদের পেটানোর সাথে সাথে পুলিশ সমুদ্রের তীরে দাঁড় করানো বোটগুলির দামী মেশিনগুলি ভেঙে ফেলতে থাকে। একজন কনস্টেবল আন্দোলনকারীদের ম্যারাপে আগুন দিতে যায়। কিন্তু একজন ক্যামেরাধারী সেটা তুলছে দেখে পিছিয়ে আসে। ওই ক্যামেরাধারী তখন পুথিয়া থালাইমুরাই-এর সাংবাদিক রামানুজন-কে ঘটনাটা বলে। ওই কনস্টেবল আরেকবার চেষ্টা করে আগুন দেওয়ার, কিন্তু বিফল হয়ে ক্যামেরাধারীকে বলে যায়, সে তার কাজে বাধা দিচ্ছে। ম্যারাপটি ভেঙে ফেলা হয়। লাইট এবং মাইক্রোফোন ভেঙে ফেলা হয়। আন্দোলনকারীদের দুপুরের খাবারের জন্য তৈরি করা রান্নাবান্নায় বালি দেওয়া হয়।
সমুদ্রের ধারে যখন একদল পুলিশ এই তাণ্ডব চালাচ্ছে, তখন আরেকদল পুলিশ, সকখ্যায় প্রায় চারশ’, ইদিনথাকারাই গ্রামে ঢোকে। মিডিয়া তখন সমুদ্রের ধারে ব্যস্ত, তারা পুলিশের সাথে ওই গ্রামে যায়নি। পুলিশ গ্রামে ঘরে ঘরে ঢুকে ছেলেদের খোঁজ করতে শুরু করে। গ্রামের শেষপ্রান্তে পৌঁছে তারা দেখে, প্রায় দেড়শ’ দুশ’ যুবকের জটলা। পুলিশ দেখে ওই যুবকেরা সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়। পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে এবং শাসাতে থাকে, পাড়ে এলে তাদের অবস্থা খারাপ হবে।
পুলিশ এরপর চার্চে ঢোকে, লুরদ্র মাথা দেবতার মূর্তি ভাঙে। পুলিশের লোকেরা চার্চে থুতু ফেলতে থাকে এবং পেচ্ছাপ করতে শুরু করে। চার্চের সামনে গড়ে তোলা ম্যারাপ টেনে নামায় এবং লাইট ভাঙচুর করে। জলের পাত্র ভেঙে ফেলে। কুদানকুলামের সরকারি জল সরবরাহ পাত্রটিও ভেঙে ফেলা হয় বলে খবর।
যেসব মহিলারা ঘরের আড়াল থেকে ঘটনাটা দেখছিল, তারা জানায়, কিছু অচেনা পুরুষ, ধুতি পরা, তারা পুলিশের গাড়িতে ঢিল ছুঁড়ছিল এবং পুলিশের লোক তার ভিডিও করছিল।
সংবাদে দেখানো হতে থাকে, কুদানকুলামের সরকারি মদের দোকান এবং পঞ্চায়েত অফিস আগুন লাগানো হয়েছে। করেছে গ্রামবাসীরা। গ্রামবাসীরা জানায়, মোটেই আগুন দেওয়া হয়নি। মদের দোকানের অ্যাসবেসটসের কিছু অংশ ভাঙচুর করা হয়েছে, একথা ঠিক। কিন্তু কোথাও আগুন লাগানো হয়নি। পরে সন্ধ্যেবেলা কুদানকুলাম থেকে প্রায় ৬৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার আগে দুপুরবেলা সেখানে ঘরঘর তল্লাসী চালানো হয়। সন্ধ্যেবেলায় ইদিনথাকারাই-এর সুনামি কলোনি-তে ঢুকে পুলিশ ঘর ঘর তল্লাসী চালায় এবং কিছু ভাঙচুরও চালায় বলে অভিযোগ। রাতে অন্তত পাঁচটি গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। তার সাথে সবার মোবাইল ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে, উদয়কুমার কোথায় লুকিয়ে আছে তা জানার জন্য।
এই পুলিশি দমনের খবর ছড়িয়ে পড়তেই আগুনের মতো প্রতিবাদও ছড়িয়ে পড়ে গোটা দক্ষিণ তামিলনাড়ুর উপকূল অঞ্চলের মৎস্যজীবী গ্রামগুলিতে। থুথুকুড়ির মানাপাড় গ্রামের মৎস্যজীবী অ্যান্থনি স্যামি (৪০) গুলিতে মারা যায়। প্রচুর মানুষ থুথুকুড়ি স্টেশনে রেল অবরোধ করে, যার জেরে মাইশোর এক্সপ্রেস দু’ঘন্টা আটকে পড়ে।
অনেক মানুষ আহত হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছে। সমুদ্রতীর থেকে গ্রেফতার হয়েছে যারা, তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে : সুন্দরী, জেভিয়ার আম্মা, সেলভি, বেদলিন, লুরদুসামি, রোজ। একজন সাংবাদিকের বয়ান অনুযায়ী, ডিআইজি রাজেশ দাস তাকে জানিয়েছেন, ২৫ জন গ্রেফতার হয়েছে।
একজন শিশু কাঁদানে গ্যাসে মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি বলে জানা যাচ্ছে, কিন্তু এর সত্যাসত্য বিচার করা যায়নি। ইদিনথাকারাই-এর লুরদু মাথা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মানুষদের তালিকা নিচে দেওয়া হলঃ
১। ডেভিড (৪৯), ২। গ্লৌদিন (৩৫), ৩। জেনিকার (২৬), ৪। সেলভান, ৫। যোশেফ (৪৯), (ইদিনথাকারাই) ৬। মাইকেল (২৮, কুথেনকুলি ) ৭। ভালান (২৩), ৮। থঙ্গস্বামী, ৯। জেনিকার (২৪), ১০। গণপ্রকাশম (৮০), ১১। কেনেডি (৫০), ১২। মহিবান (৩) ১৩। ইনিথা (মহিলা) ১৪। চেন্নামাল (মহিলা), জেশু আম্মাল (মহিলা)।
এছাড়া তিনজন আহতকে পুলিশ ইদিনথাকারাই এর হাসপাতাল থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেছে, কোথায় তা জানা যাচ্ছে না। সেই তিনজন : সেলসন, সিলুভাই জন এবং জেশু, তিনজনেই পুরুষ।
তামিলনাড়ুতে অন্ত্যজ অংশের প্রতিবাদকে হিংস্রভাবে দমন করার ঐতিহ্য রয়েছে। ১৯৯৯ সালে ১৭ জন দলিত চা শ্রমিককে তাড়া করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল পুলিশ, তিরুনেলভেলিতে। এক বছর আগে পালামাকুড়িতে দলিতরা তাদের নেতা ইমানুয়েল শেকরণকে সম্মান প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে, পুলিশ তাদের তাড়া করে এবং গুলি চালিয়ে ৬ জনকে মেরে ফেলে এবং ৩০ জনেরও বেশি আহত হয়।
Leave a Reply