- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

“ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আইন” এর দাবিতে উত্তর ভারতের চাষিদের দিল্লী অভিযান নিয়ে বাংলার চাষিরা কী ভাবছে?

সংবাদমন্থন প্রতিবেদন। নদিয়া।

বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখায় গৌতমদা। জিগ্যেস করলাম, পাঞ্জাবের চাষিরা আবার দিল্লির দিকে যাচ্ছে, কিছু জানো ওদের আন্দোলনের ব্যাপারে। সটান উত্তর, আমি চাষি নই। ও নিয়ে আমার তাই আগ্রহও নেই কোনো।

নিজের অল্প কিছু জমিতে সার বিষ ছাড়া শাকসব্জি চাষ করে বিক্রম। ও শুনেছে বটে কৃষক আন্দোলনের কথা। বিস্তারিত জানে না কিছু তেমন।

কলকাতার এক ফিল্ম ইন্সটিউটের ছাত্রী মৌমিতা। সে বলল, ‘হ্যাঁ। খুব খারাপ ব্যাপার। একজন পুলিশের গুলিতে মারা গেছে।

২২ ফেব্রুয়ারি হরিয়ানার খানৌরি সীমান্তে কৃষকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত ২১ বছরের শুভকরণ সিং কে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার দাবী উঠেছে

কিন্তু ওদের দাবীটা কী? মৌমিতা বললো, ওরা আসলে বাজারে যে দামে চাষের মাল বিক্রি করছে, বাজার সেটার চেয়ে অনেক বেশি দামে ক্রেতার কাছে বিক্রি করছে, ওরা এটার প্রতিবাদ করছে।

আন্দোলনরত কৃষকের মৃত্যু দিয়ে ওর কৃষক আন্দোলন ২.০ এর ব্যাপারে জানাশোনা শুরু হলেও আসল ব্যাপারটা ও খানিক বুঝেছে নিজের মতো করে।

মরশুমি চাষে মাঝে মাঝেই দেখা যায়, ডাঁই করে পেঁয়াজ বা টমাটো রাস্তার মাঝখানে ফেলে রেখে জলের দরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে চাষি। বা, এত দাম কম, যে ডালায় চাপিয়ে বাজার অব্দি নিয়ে যাওয়ার দামও উঠবে না। তাই জমিতেই চাষি ফেলে রেখে দিচ্ছে আলু। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের চাষিরা আসলে এর সমাধান চেয়ে দিল্লির দ্বারে হাজির হয়েছে।

তাদের দাবি, একটা আইন হোক, “ন্যুনতম সহায়ক মূল্য” আইন, যাতে ২৩ টি ফসলের ন্যূনতম দাম কত পেতে পারে চাষি, তা বেঁধে দেওয়া হবে। হিসেবটা হবে, খরচের দেড়গুণ। বাজারে যদি অত দাম না পাওয়া যায়, তাহলে যতটা কম পাওয়া গেল, তা মেটাবে সরকার। চাষিদের দাবী কিন্তু এটা নয় যে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে সরকারকে সব চাষির সবটুকু মাল কিনে নিতে হবে।

এপর্যন্ত শোনার পর আমাদের গ্রামের এক চাষীর ছেলে, তরুন, যে নিজেও মাঠে বাবার সাথে চাষের কাজ করে আবার টোটোও চালায়, বলছিলো, কিন্তু সবকিছুর তো দাম বেঁধে দিতে পারছে না সরকার। শুধু ধানই তো কেনে দেখি ওরা। ধানের দামটা ওরা বেঁধে দেয় বলেই যেন দু’বার ধান করতেই হবে সব চাষিকে। তা’ছাড়া মান্ডিতে তো দেখি, শুধু মোটা ধানটাই নেয়। মিনিকিট কেনে না তো।

তরুনদের আসলে জমি কম বলে দূরের মান্ডিতে গিয়ে ধান বেচতে সুবিধে হয় না। ঘরের উঠোনে এসে দালালরা ধান নিয়ে যায়। দাম অবশ্য সরকারের রেটের থেকে কম দিতে পারে না। কিন্তু ধলতায় কেটে নেয় বেশি। আর ওর জানাও নেই এমএস পি আইনের আওতায় থাকা তেইশটা কৃষিপণ্যের মধ্যে ধান, গম, ভুট্টা, জোয়ার, বাজরা, রাগী ছাড়াও পাট, তুলো, সর্ষে, সূর্যমুখী, নারকেল শাঁস, অড়হড়, কলাই প্রভৃতি ডাল, এমনকি তিল, পাট- এসবও আছে। বাস্তবতা এটাই যে গোটা দেশেই মূলত ধান আর গমটারই একটা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বছরে দুবার সরকারগুলো বেঁধে দেয়। অন্যগুলোর, অন্তত আমাদের রাজ্যে, কোনো ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বেঁধে দেওয়া হয় না।

খাদ্যশস্য ডালতৈলবীজ বাণিজ্যিক শস্য
ধানমুসুরচিনাবাদাম আঁখ
গমকলাই তিলতুলো
ভুট্টাঅড়হর সূর্যমুখীপাট
জোয়ার মটররাইসর্ষেনারকেলের শুকনো শাঁস
বাজরামুগসোয়াবিন
রাগীকুসুম
বার্লিনাইজার
ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারিত হওয়ার কথা যে তেইশটা কৃষিপণ্যের

এবছর শীতকালটায় অসময়ে বৃষ্টি হওয়ায়  সর্ষে চাষ ভালো হয়নি। ফলন কম। যেটুকু যা হয়েছে, দানা ভালো হয়নি। পরিমাণে কম হবে তেল। যারা সর্ষে করেছে, তারা সবাই সর্ষে তুলে ধান করতে পারবে না। তিল বুনবে। যাদের সর্ষের বদলে ধান ছিল, তারা ধান তুলে পাট করবে। ফলে সর্ষে বা ধানের ক্ষতিটা তিল কিম্বা পাটের লাভ দিয়ে তুলে আনতে হবে। কিন্তু আবহাওয়ার কথা কে বলতে পারে? ধান আর পাটটা তাই চাষিকে যেন করতেই হবে। অন্য ফসলগুলোর দামও যদি আইন অনুযায়ী সরকার বেঁধে দিত, তাহলে হয়তো এই বাধ্যবাধকতাটুকু থাকতো না। জমির অবস্থাও ভালো থাকতো। রাসায়নিক সার, কীটনাশক কম লাগতো জমিতে। এমনিতেই আমাদের এখানে সকলেরই কম জমি। ঘরেরটুকু রেখে আর বিক্রি করার মতো ধান থাকে না হাতে। সময়ে অসময়ে তাই ঘরোয়া দালালদের উপর নির্ভর করতেই হয়। মান্ডিতে তো আর সারা বছর ধান নেয় না। এসব কারণেই চাষ আর সম্ভাবনাময় পেশা নয়। সম্মানের তো নয়ই। তরুনদের টোটো চালাতে হয়ও এজন্য। চাষের খরচটা তো জোটাতে হবে।

গৌতমদা, আমরা, যারা শহরে থাকি, জমিজায়গা নেই বা কম, বাজারে গিয়ে কুড়ি টাকা কেজি কুমড়ো কিনতেও দুটাকার জন্য দাম করি। অথচ কোনো মল থেকে একটা প্রোডাক্ট কিনতে গেলে এম আর পি দেখে দাম দিই। দামাদামি চলে না সেখানে। তরুণের বাবা ন’মাস হলো ঝাল বুনেছে বারো কাঠায়। রোজ ভোরে পাইকারি হাটে লঙ্কা নিয়ে আসে। ফেরার পথে ওর গাড়িতে যেতে যেতে প্রতিদিন জিগ্যেস করি, আজ কত করে বেচলে?

যেদিন তেরো টাকা কেজি বিক্রি হয়, সেদিন আমাদের শহর-বাজারে আমায় লঙ্কা কিনতে হয় অন্তত পাঁচ টাকা শ’য়ে। চাষিরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে কিন্তু তিন চার চার গুণ বেশি দাম পেতে পারতো। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তারা তো সেটা পারেনা। দেশের মানুষের পাতে আগে খাবারের নিশ্চয়তা চাই। অথচ নিজেদের ফসলের দামটা নিশ্চিত করতে চাইলে তাদের পথে নামতে হয়। নইলে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে একটা আইন ঠিক করতে পারছে না কেন সরকার?

ন্যূনতম সহায়ক মূল্যন্যূনতম সহায়ক মূল্য আইন
ন্যূনতম সহায়ক মূল্য মানে হল সেই দাম যা দিয়ে চাষির কাছ থেকে কিনবে সরকার এবং প্রাইভেটরা চেষ্টা করবে। কিন্তু প্রাইভেট পার্টির ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কমে কেনা বেআইনি নয়ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আইন মানে, নির্ধারিত দামের কম দামে কেনা বেআইনি। সেক্ষেত্রে চাষি তার বিরুদ্ধে কোর্টে যেতে পারে বা থানায় নালিশ করতে পারে
আইন থাকা আর না থাকার তফাৎটা কোথায়?

এতদূর কথাবার্তা চলার পর গৌতমদা বলল, কই আমরা তো খবরের চ্যানেলগুলোয় এভাবে শুনিনি। তবে এটা বোঝা যায়, যে সরকারই ক্ষমতায় আসে, তারাই এম এস পি’র দাবীটাকে বলবৎ করতে পারে না। অথচ বিরোধী দল হিসেবে থাকলেই তারা এটাকে আইন করার প্রতিশ্রুতি দেয়। তরুন জবাব দেয়, এতদিন ভাবতাম, পাঞ্জাবে চাষিদের অনেক জায়গাজমি, পয়সাকড়ি। তাই সরকারকে প্যাঁচে ফেলতে ভোটের আগে ওরা গাড়িটাড়ি নিয়ে দিল্লির দিকে যায়। মিডিয়ায় তো তেমনই দেখি। এবার বুঝতে পারছি, কেন ওরা বারবার রাস্তায় নামছে। রাস্তায় এসে না দাঁড়ালে তো আজকের এই কথাগুলো আমরাই জানতে পারতাম না।