- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

এমন দিন আসছে, যখন আপনি মানিব্যাগ খুলে ভাড়া দিতে পারবেন না। ছিনতাই হয়ে যাবে।

সাত মাসের লকডাউন কি আকালের সম্ভাবনা তৈরি করেছে? একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন- ১

সংবাদমন্থন প্রতিবেদন। ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০।#

‘সরকার যাদের হিসাব রাখে না ৫’ – এঁকেছেন আনখ সমুদ্দুর

মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ভি কে সিং লোকসভায় বিবৃতি দিয়ে জানান, এবছর মার্চ থেকে জুন মাস অবধি এককোটির বেশি শ্রমিক করোনা অতিমারির কারণে ডাকা লকডাউনের মধ্যে পায়ে হেঁটে, সাইকেলে বা অন্য নানা  উপায়ে নিজের নিজের বাড়ির রাজ্যে ফিরেছেন। আরেকটি হিসেবে তিনি জানান, ওই একই সময়কালে দেশে ৮১,৩৮৫ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯,৪১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। যদিও তার মধ্যে ভিনরাজ্য ফেরৎ শ্রমিকদের কতজন, তা আলাদা করে সরকারের খাতায় হিসেব নেই। আর এই লকডাউনে কাজ হারিয়ে, ছাঁটাই হয়ে, কাজে যেতে না পেরে দেশের একশ পঁয়ত্রিশ কোটিরও বেশি মানুষের হাঁড়ির হাল আমরা না জানলেও প্রতিদিন করোনায় কতজন আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছেন তার খতিয়ান অষ্টপ্রহর জেনে যাচ্ছি সমস্ত বাজারি মিডিয়া থেকে। লকডাউনের শুরুতে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও স্থানীয় বিত্তবানদের দান-খয়রাতি, রাষ্ট্রের যা করা উচিত ছিল, তার হয়ে কিছুটা ফাঁক পূরণ করেছিল। কিন্তু দু’একবার ত্রাণে যে কর্মসংস্থানের উপায় বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সুরাহা হবেনা, তা বুঝেছিলেন এই পাশে থাকা সংগঠনগুলির অনেকেই। সেই দুশ্চিন্তা থেকেই ২৪ অগাস্ট শুভেন্দু দাশগুপ্ত পত্রিকার দপ্তরে একটি চিঠি পাঠান, যাতে লেখা ছিল,

নদিয়া জেলার চাকদহের একটি গ্রামে, শান্তিপুরের দুটি গ্রামে, শান্তিপুর শহরের একটি এলাকায় বন্ধুরা নিজেরাই সমীক্ষা করে। সমীক্ষায় মোটা দাগে এই বিষয় কটি জানা যায় —-

১/ প্রতিটি পরিবারের রোজগার হয় একই আছে কিংবা কমেছে।

২/ বেশিরভাগ পরিবারে রোজগার করে একজন। ফলে একজনের রোজগার না থাকলে, কমলে, সেটা সারা পরিবারেরই অবস্থা।

৩/ খরচ কমছে না, কারণ এই পরিবারগুলিতে খরচের বেশির ভাগই যায় সংসার চালাতে, খাবারে আর ওষুধে।

৪/ সরকারের কাছ থেকে রেশনে, নানা প্রকল্পে যতটা পাবার কথা, ততটা খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাজারে যেতে হচ্ছে। বাজারে খাবারের দাম কম নয়।

৫/ সবাই বলেছে, সরকারকে ওদের পাশে দাঁড়াতে হবে খাবার দিয়ে, কাজ দিয়ে।

৬/ আর এক ভাবে দাঁড়ানো যায়, যদি সবাই মিলে মিশে কিছু করা যায়।

এই হলো সমীক্ষা থেকে যা জানা গেছে, তার সার কথা। যদি অবস্থাটা একই রকম হয়, আর একই রকম থাকে, তাহলে ভয় পাবার কথা। না খেতে পাওয়ার ভয়, না খাবার পাওয়ার ভয়, আকালের ভয়।

এই ভয় কাটানোর উপায় বের করতে হবে। সরকারের কাছে গিয়ে বলতে হবে সাহায্য করার জন্য। আর নিজেরা একসাথে হয়ে কিছু একটা করতে হবে।

তার আগে জেনে নিতে হবে, এমন অবস্থা সব জায়গায় কিনা। যা নদিয়া জেলার কয়েকটি গ্রামে, তা বাংলার অন্য এলাকাতেও ? নদিয়া জেলায় যাদের নিয়ে সমীক্ষা, তাদের কাজ গ্রাম ভিত্তিক, চাষ ভিত্তিক। সব জায়গাতে তা তো নয়।

অনেক ধরনের এলাকা রয়েছে, অনেক ধরনের কাজে থাকা, অনেক মানুষজন রয়েছে। যেমন ছোট কারখানার মজদুর, মৎসজীবী, কুমোর, কারিগর, হস্তশিল্পী, তাঁতী, দর্জি, হকার, নানা ধরনের ছোট গাড়ির চালক, রিক্সা, ভ্যান, ঠেলা, নানারকমের ছোট ছোট কাজে থাকা লোকজন। তাই অন্য অন্য জায়গা থেকে অবস্থাটা জানা দরকার।

………………

জানার বিষয় মোটামুটি এই রকম —

রোজগার, খরচ, ধার, শোধ, সরকারের কাছ থেকে পাওয়া, না-পাওয়া।

যদি দরকার লাগে, খুঁটিনাটি বিষয় পরে জানার চেষ্টা করা যেতে পারে।

আপাতত এভাবেই শুরু করা যাক।

সেই মোতাবেক সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে সমস্ত সমীক্ষা প্রতিবেদন পাওয়া গেল, তা আসলেই উদ্বেগজনক।

সুজয় জানার প্রতিবেদন।

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০।

 

বাদল পন্ডিত। বয়স পঞ্চান্ন। প্রায় তিরিশ বছর ধরে মাছের ব্যবসা। দীঘা থেকে মাছ নিয়ে অস্তিতে বিক্রি। কারবার শুরু ভোর চারটে থেকে। চলে দুপুর দুটো-আড়াইটে অবধি। শুধু বাদল নয়। মাছ ভেন্ডরদের সকলকেই এই অমানুষিক খাটতে হয়। মাছ কিনতে মূলধন লাগে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। লাভ হয় কোনোদিন চারশো, কোনোদিন দু’শো। কোনোদিন মূল থেকে লোকশান যায়। হঠাৎই এল করোনা অতিমারির আবহ। লকডাউন ঘোষিত হল। ঘরবন্দি হল মানুষ। বাদল দেখল অভাবের অন্ধকার। দিন আনা দিন খাওয়া বাদলের পরিবারে মাত্র চারজন। তার কোনো জমানো টাকা নেই। জমিজিরেত নেই। জন মজুরি করার অভ্যাস নেই। না হলেও জন খাটার সুযোগ নেই। ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। লকডাউনের দিনগুলোতে বাদল দোকান থেকে ধারে মালপত্র কিনেছে। তাতেও হয়নি। অন্য অন্য খরচের জন্য মহাজনের কাছে তাকে হাত পাততে হয়েছে।

বাদল জানিয়েছে, সরকারি বা বেসরকারি কোন ত্রান তাদের পরিবারে পৌঁছায়নি। রেশন পাওয়া গেছিল। যৎসামান্য।

লকডাউনের মধ্যে এল আমফান ঝড়। ঝড়ে ঘরের চালা উড়িয়ে নিয়ে গেছে। ঘরামিকে দিয়ে চাল সারাতে হয়েছে। মধ্যে একবার লকডাউন উপেক্ষা করে ব্যবসায় বার হচ্ছিল। দীঘা যাওয়ার পথে পুলিশ হয়রানি করল। এখন লকডাউন শিথিল হয়েছে। কিন্তু কারবার আর আগের আগের মত জমেনি। এখন প্রায়ই লোকশান হয়। মানুষ একটা ত্রাসের মধ্যে আছে। আর ব্যবসায়ী বেড়ে গেছে। ভিনরাজ্যফেরৎ শ্রমিকরা অনেকেই মাছ ভেন্ডিং করছে। হকারি করে মাছ দোরে দোরে পৌঁছে দিচ্ছে।

এই অতিমারি আবহে চলতে চলতে বাদলের করোনার ভয় অনেকটা কমে গেছে। কারণ করোনা ধরলে হয়তো একবার মরতে হবে। কিন্তু করোনার ভয়ে সিঁটিয়ে যেতে যেতে এতো প্রতিদিন তিল তিল করে মরা। তার চিন্তা দিনের শেষে অন্তত শ’দুয়েক টাকা যেন লাভের ঘরে আসে।

 

সুরঞ্জন প্রামানিকের প্রতিবেদন।

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০।

 

গ্রাম- মন্ডলপাড়া।

জেলা- উত্তর ২৪ পরগণা।

বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে কথা বলে যে ধারণা হয়েছে, তা’ই জানাচ্ছি।

‘সরকার যাদের হিসাব রাখেনা ৭’ – এঁকেছেন আনখ সমুদ্দুর

সাধারণ মুদিখানার আয় ২৫-৩০ শতাংশ কমেছে।

মিস্টির দোকানের আয় ৫০ শতাংশ কমেছে।

সবজির দোকানের বেচাকেনা ভালোনা। শতাংশ হিসেব জানা সম্ভব হয়নি। ভ্যান রিক্সার আয় অনিয়মিত। দিনে ১০০-১৫০ টাকা। নির্মাণ কর্মীদের মজুরির দাম ঠিক আছে। কাজ অনিয়মিত। মাছের বাজার ভালো না। খরিদ্দার কম। পোল্ট্রি মাংসের বাজার ভালো। মাছ মাংস বিক্রেতাদের আয় জানা সম্ভব হয়নি। কলা বিক্রেতাদের ব্যবসা খারাপ আমফানের কারণে।

সবারই আয় বুঝে খরচ। ধারদেনার কথা স্পষ্টভাবে কেউ বলতে চায়নি। যারা টাকা ধার দেওয়ার কারবার চালায়, তারা জানিয়েছে- ধার নেবার লোকের সংখ্যা কমেছে। লোক বুঝে ধার দেওয়া হচ্ছে। টাকা শোধ দেওয়া অনিয়মিত। সরকারের কাছ থেকে কেউ কেউ বার্ধক্যভাতা, বিধবা ভাতা, শিল্পীভাতা, আমফানের ক্ষতিপূরন বাবদ টাকা পাচ্ছে। চাল, গম পাওয়া যাচ্ছে। তা বিক্রি করে কিছু টাকা পাওয়া যাচ্ছে। আগামীদিন কীভাবে চলবে কেউ স্পষ্ট কিছু জানেন না।

 

জাতিশ্বর ভারতীর প্রতিবেদন।

২২ সেপ্টেম্বর, ২০২০।

 

১) নামঃ চন্দন রায়

নিবাসঃ বানারহাট, জলপাইগুড়ি

পেশাঃ নির্মাণ শ্রমিক

বাড়িতে বাবা, স্ত্রী, এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। মেয়ে ক্লাস সেভেনে। স্ত্রী রোজগার করেননা। জব কার্ড পাওয়ার জন্য স্ত্রী অনেক চেষ্টা করেও পাননি। বাবা টোটো চালান। নিজের টোটো নয়। ভাড়ায় নেওয়া।

হায়দ্রাবাদে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। লকডাউন হবার পর চলে এসেছেন। এখনও কোনো কাজ পাননি। শুরুতে একবার সরকারের তরফ থেকে ৪০ কিলো চাল দেওয়া হয়েছিল। তারপর আর কিছু পাননি। বাবা ও স্ত্রীর বি পি এল কার্ড আছে। খাবারটা কোনোরকমে জুটে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের অনেকরকম প্রয়োজন থাকে। সেজন্য স্ত্রীর সামান্য গহনা এবং নিজের আংটি বন্ধক দিতে হয়েছে।

চন্দন হায়দ্রাবাদ ফিরে যেতে পারছেন না, কারণ, আসবার সময় ঠিকাদারের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে এসেছেন। সেটা শোধ দেবার মত অবস্থায় নেই।

 

২) নামঃ পরিমল রায়।

নিবাসঃ পাঙ্গা, জলপাইগুড়ি।

পেশাঃ রিক্সাচালক।

দুই মেয়ে, দুজনেই স্কুলে পরে। স্ত্রী ১০০ দিনের কাজ কিছুদিনের জন্য পেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর যোজনার ৫০০ টাকা অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে। রিক্সা নিজের। জলপাইগুড়ি শহরে চালান। লকডাউনের সময় প্রায় একমাস রিক্সা বন্ধ রাখতে হয়েছে। ফলে জমানো টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখনও তেমন রোজগার হচ্ছেনা। বলেলন, মাস্টারমশাই, এমন দিন আসছে, যখন আপনি মানিব্যাগ খুলে ভাড়া দিতে পারবেন না। ছিনতাই হয়ে যাবে।

 

৩) নামঃ পিন্টু সরকার

নিবাসঃ জলপাইগুড়ি

পেশাঃ বেসরকারি বাস কন্ডাকটর

বাড়িতে ভাই, এক স্ত্রী, এক ছেলে আছে। ভাই টোটো চালায়। ছেলে স্কুলে পড়ে। লকডাউনের সময় টোটো, বাস সব বন্ধ ছিল। ভাই তখন থেকে রাস্তার ধারে বসে সবজি বিক্রি করে। ছেলা তাকে সহযোগিতা করে। বাস এখনও চালু হয়নি। তাই সুবোধ এখন ভাই এর টোটো চালান।

বাস মালিক শুরুতে মাস দু’এক বেতন দিয়েছে। তারপর আর দিতে পারবেনা বলে দিয়েছে। বাস চালু  থাকলে বেতন ছাড়াও উপরি রোজগার হয়। সেটা তখন হয়নি। এখন বেতন , উপরি সব বন্ধ। বি পি এল কার্ড আছে সকলের। রেশনে যা দেয়, তা পাওয়া যায়। কিন্তু যা দেবার কথা সব সময় সবটা দেওয়া হয়না। টোটো চালিয়ে চলে যাচ্ছে তবে আগের তুলনাতে জীবনযাত্রার মান কমেছে। ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত।

 

অঙ্কুশ দাসের প্রতিবেদন।

৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০।

 

গ্রাম- রায়পুর, জেলা- বীরভূম।

একজন মৃৎশিল্পী, ঠাকুরগড়ার কারিগরের কথা।

বাসদেব রায়, বয়স ৪২।

দুর্গা, সরস্বতী, মনসা, বিশ্বকর্মা ঠাকুর গড়েন। এই পেশার সাথে আছেন ২৫ বছর। বাড়িতে ওনাকে ধরে তিনজন। ছেলে লেখাপড়া করে। ১১ ক্লাস। সরকারি স্কুল। দুর্গা ও সরস্বতীর বাইরে এবারে অন্য ঠাকুর বায়না অনেকটাই কম। আগের আগের বছর ২০টা ঠাকুর। এবছর দশটা।

দুর্গা ঠাকুরের বায়নাও এ বছর কম। গত বছর ১১টা, এবছর ৭টা।

যারা ঠাকুর বানাতে দিয়েছে, বলেছে ঠাকুর ছোটো করতে হবে। বানানোর খরচ কমাতে বলেছে। এদিকে ঠাকুর বানানোর মালপত্তরের খরচ বেড়েছে। ফলে মৃৎশিল্পীর ক্ষতি। ওনার হিসেবে যদি গত বছর ১০০ টাকা আয় হয়ে থাকে, এবছর ৫০ টাকা আয় হবে।

আগে মাসিক আয় ছিল গড়ে ছ’হাজার টাকা। ঠাকুর গড়ার সময়ের আয় থাকা, আর ঠাকুর গড়ার যখন সময় নয় তখন আয় না থাকার গড় হিসেব কষে। এখন সেই গড় মাসিক আয় নেমে গেছে ৩ হাজার টাকায়।

আর খরচের কোনো হেরফের নেই। মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। প্রধান খরচ সংসার চালানো, আর ছেলের পড়াশোনা। এখনকার অর্থনীতির সামনে দাঁড়িয়ে বাসদেব রায়ের দুশ্চিন্তা হচ্ছে সংসার চালানো নিয়ে। ছেলেকে মানুষ করা নিয়ে।

সরকারের কাছ থেকে রেশনে যা পাওয়া যায়, মাসে ৭ কেজি চাল, ২ কেজি আটা, তাতে সারা মাস চলেনা।

বাজারে যেতে ভয় এই মৃৎশিল্পীর। সরকারের কাছে চাইছেন সাহায্য, তার ব্যবসার কাজে সাহায্য।