- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

সরকার যখন দুয়ারে – শ্রমিকরা তখন কাজের খোঁজে দূরে

মুহাম্মদ হেলালউদ্দিন। হাতিয়াড়া। ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১।#

মুর্শিদাবাদ উদ্বৃত্ত মজদুরের জেলা। জনসংখ্যা বেড়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকও বেড়েছে। প্রতি দশ বছরে এক থেকে দেড় লক্ষ কৃষিশ্রমিক বাড়ে। শতাংশের হিসেবে চার থেকে দশ শতাংশ। পরিযায়ী শ্রমিকও গত ৭৫ বছরে এক লক্ষ থেকে বেড়ে প্রায় পাঁচ-ছ’ লক্ষ হয়েছে। লকডাউনের সময় তারা বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়েছে। জেলায় চাপ বেড়েছে শ্রমিকের। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা মুর্শিদাবাদ। স্বাভাবিক ভাবেই পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে মুসলমানের আধিক্যই বেশি। এরা বাঙালি আবার মুসলমান। বাইরের রাজ্যে তাদের প্রায়ই বাংলাদেশি বলে। পুলিশের হেনস্তার শিকার হতে হয়। এমনকি পুশব্যাক করার চক্রান্তও হয়। অনেকের স্মরণ আছে নিশ্চয়ই, লকডাউনের শুরুতে বহু শ্রমিককে মুম্বাই পুলিশের পাহারায় মুর্শিদাবাদের সীমান্তে আনা হচ্ছিল। হাওড়ার বাগনানে তাদের নিয়ে ঝামেলা করে স্থানীয় মানুষেরা। তাতে হাওড়া-হুগলির লোকও ছিল। তাদের আত্মীয় স্বজনরা আটকায়। পরে উদ্ধার করা হয়।

একসময় মুর্শিদাবাদ ছিল অবিভক্ত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী। রাজার দেশ। এখন রাজমিস্ত্রির জেলা। জেলার লক্ষ লক্ষ শ্রমিক নির্মানশিল্পে সারা দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে। এমনকি বিদেশেও। নিজের রাজ্যের বিভিন্ন জেলাতেও রাজমিস্ত্রির কাজে যুক্ত। দুবাইতে বিশ্বের সর্বোচ্চ বাড়িটি (বার্জ খলিফা) তৈরিতেও বেলডাঙ্গা তথা মুর্শিদাবাদের রাজমিস্ত্রিদের বিরাট ভূমিকা। কলকাতায় নাখোদা মসজিদের সংস্কারের জন্যও ডাক পড়ে মুর্শিদাবাদের মিস্ত্রির। মুর্শিদাবাদের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ মানুষই জেলার বাইরে পরিযায়ী শ্রমিক। এই শ্রমিকদের দেশে বিদেশে নির্যাতিত হতে হয়। ফলে কখনো কখনো তাদের মৃত্যুও হয়। নানান অপবাদ তাদের ভাগ্যে জোটে।

মুর্শিদাবাদ জেলার পঁচাশি শতাংশ মানুষই কৃষিজীবী। কিন্তু জমিতে কাজ থাকে তিন চার মাস। বাকিসময় রুটিরুজির জন্য পরিযায়ী শ্রমিক হওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। মুর্শিদাবাদে শিল্প নেই বললেই চলে। যা ছিল তার ঝাঁপ বন্ধ। নতুন কোনো বড়ো, ভারী শিল্প গড়ে ওঠেনি। স্বাধীনতার পর কয়েকটি মিল বন্ধ হয়ে গেছে। যেমন মণীন্দ্র মিল, কাশিমবাজারের বস্ত্রমিল, বেলডাঙ্গার চিনির মিল। সত্তর দশকে মণীন্দ্র মিল সারা ভারতে কাপড় উৎপাদনে প্রথম স্থান অধিকার করত। এখন সব বন্ধ।

বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে বাম আমলে রেজিনগরে শিল্পতালুকের ভিত্তি স্থাপন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে। তারই আবার শিলান্যাস করেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তৃণমূলের দশ বছরেও আলো জ্বলে ওঠেনি। বহরমপুরে শিল্পতালুকের উদ্বোধন হয় বাম আমলে। সেখানেও কোনো শিল্প গড়ে ওঠেনি। বেলডাঙ্গার চিনির মিল সাড়ে ছয় দশকের ওপর বন্ধ। জলের দামে এটি বাম আমলে নফরচন্দ্র জুট মিল মালিককে বিক্রি করে দেয়। মণীন্দ্র বি.টি. মিল জলের দামে বিক্রি হয় বাম আমলেই। রাজা আসে, রাজা যায়। শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। কলকাতার আনাচে কানাচে রাজমিস্ত্রি, ফেরিওয়ালা এবং নানান কাজে যুক্ত মুর্শিদাবাদের মানুষের দেখা মেলে। এমন কিছু মানুষের সাথে কথা হয় হাতিয়াড়ায়। তারা অনেকেই ছিল পরিযায়ী শ্রমিক। এখন ফেরিওয়ালা। তারা প্রতিদিন সকাল ৮-৯ টার সময় ভ্যান ভর্তি করে কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে হরেক জিনিসের পসরা নিয়ে। সারাদিন পথে পথে ঘুরে হাতিয়াড়ার ডেরায় ফেরে। এখানে ডেরা গেড়েছে তিনশ’রও বেশি শ্রমিক। হাতিয়াড়ায় বিভিন্ন পাড়ায় ৩০-৪০ জন করে একসঙ্গে থাকে। সাথে থাকে তাদের মহাজন। মহাজনের সংখ্যা জনা দশেক হবে। তারা কলকাতার বড়বাজারে মুর্শিদাবাদের ওমরপুর থেকে মাল নিয়ে এসে দেয়। সেইসব নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিশির মন্ডল, সেন্টু সেখ, কাশেম আলিরা।

সাইকেল ছাড়া যাদের দিন চলে না। ইসলামপুর থেকে সুশান্তের তোলা ছবি।

তন্টুল সেখ একজন মহাজন। বাড়ি ওমরপুরের কাছে। তার সঙ্গে রয়েছে দশ থেকে পঁচিশ জন ফেরিওয়ালা। তাদের বাড়িও তন্টুল সেখের এলাকায়। শিশির মন্ডল, দশরথ মন্ডলদের বাড়ি রঘুনাথগঞ্জ থানার বীরেন্দ্রনগরে। তারা বলেন, ‘মহাজনের কাছে মাল নিয়ে সারাদিন ভ্যানে করে পাড়ায় ঘুরি। ভ্যান রাখার জায়গা মহাজন দেয়। আমরা সারাদিন বিক্রি করে হিসেব করে মহাজনের কাছে টাকা মেটাই। যেসব মাল কম পড়েছে, সেগুলি নিই। পরেরদিন আবার মাল নিয়ে সকালে বেরিয়ে পড়ি। সন্ধ্যায় ফিরি। ডেইলি তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত ইনকাম হয়। মহাজনই বাড়ি থেকে নিয়ে এসে আমাদের পথে নামিয়েছে। আমাদের চিনাজানা লোক মহাজন’।

রাকিব সেখের বাড়ি সাগরদিঘি থানার ফুলবাড়ি গ্রামে। রাজমিস্ত্রির হেল্পার, সিজনে চাষের কাজে দিনমজুরি। ‘লকডাউনের আগে বোম্বাই ছিলাম। এখন হকারি করছি। জমিজায়গা নাই’। জিজ্ঞাসা করি, আপনাদের মাল কোথা থেকে আসে? ‘বেশিরভাগ মুর্শিদাবাদের ওমরপুর। আরো অনেক জায়গার। তবে আমরা অতসব বুঝিনা। মহাজন আনে’।

সেন্টু সেখ, কাশেম আলির জঙ্গীপুর, ফুলতলায় বাড়ি। ভূমিহীন। হাতিয়াড়ার গেটে থাকে। গড়ে চারশ থেকে পাঁচশ টাকা আয়। ওমরপুরে প্লাস্টিকের বদনা, ঘটি, কুলো, ঝুড়ি, মগ, জগ অনেক কিছুই তৈরি হয়। হাতিয়াড়ায় হাজার খানেক লোক পাবেন। রাজমিস্ত্রি বেশি। কেষ্টপুরের দিকে অনেকেই আছে। জঙ্গিপুর মহুকুমার লোক বেশি। লকডাউনে গাঁয়ে এসেছিলাম। অনেকেই আবার বোম্বাই, দিল্লি, কেরলে যাচ্ছে। আমরা যাইনি। নিজের গাঁ-ঘরের কাজ পেলে ভালো হয়। স্বাস্থ্যসাথী হলেও আমরা কেউ করতে পারিনি। বাড়িতে থাকিনা। যেতে হলে গাড়িভাড়া লাগে চার-পাঁচশ টাকা। বাইরে চুপ মেরে থাকতে হয়। ভয় টয় লেগেই আছে। গাঁয়ের মত সুখ কোথায়? সরকার দুয়ারে আর আমরা বাইরে। বউ, বাচ্চাকাচ্চারা ঘরে। আমরা বাইরে। খাওয়া শোয়ার ঠিকঠিকানা নাই। কষ্টের মধ্যে দিন গুজরান।