- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

বাঙালি মুসলমান পরিবারের গৃহবধূর চোখে তিন প্রতিবেশী দেশে ঈদ-উল-ফিতর

মেটিয়াবুরুজের বড়তলা অঞ্চলে এক বাঙালি মুসলমান পরিবারের গৃহবধূ নাইমা পারভীন। জন্মেছিলেন পাকিস্তানের করাচি শহরে। বাবার চাকরি সূত্রে সেখানে তাঁদের বসবাস ছিল তাঁর কলেজজীবন পর্যন্ত। এরপর কয়েক বছর বাংলাদেশের ঢাকায়। তারপর বিবাহ সূত্রে এখানে মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দা, পঁয়ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। রমজান মাসের শেষে মুসলমানদের যে সবথেকে বড়ো আনন্দের পরব ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ উৎসব — বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে থাকাকালীন তা কীভাবে পালন করেছেন এবং পালন হতে দেখেছেন সে সম্বন্ধে সংবাদমন্থনের প্রতিবেদককে তিনি যা বলেছেন তা লিপিবদ্ধ করা হল।  #
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি আমাদের সবথেকে বড়ো পরব এই ঈদ-উল-ফিতর। আমাদের সাত বছর বয়স থেকেই নামাজ পড়তে এবং বারো বছর বয়স থেকেই রমজান মাসে রোজা রাখতে শেখানো হয়। একদম ছোটোবেলায় বুঝতাম এটা খুব আনন্দের সময়, নতুন জামাকাপড় পরে সবাই সবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করা, মেলামেশার পরব এটি।
হ্যাঁ এটা ঠিক যে বিভিন্ন কারণে কোনো কোনো সময় তিনটে দেশে থাকার ফলে সেখানে ঈদের উৎসব কেমন পালন হয় তা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তবে ঈদের মূল বিষয়টা কিন্তু সব জায়গায় একই। রমজান মাসে চাঁদ উঠলে একমাস রোজা, তারপর ঈদের চাঁদ (সাওয়াল) দেখলে রোজা শেষ। আবার রোজাতে সেহরি খাওয়া, ইফতার করা, ছোলা রান্না, পেঁয়াজি করা, ঈদে নতুন জামাকাপড় কেনা, জুতো কেনা, ঈদের দিন সকালে নামাজ পড়ার পর একে অপরে গলা মিলিয়ে ঈদ মুবারক জানানো, বাড়িতে সিমাই রান্না করা, ঈদের দিন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি গিয়ে দেখা করা, বড়োরা ছোটোদের ঈদি দেওয়া (পরবি) এগুলো সবজায়গাতেই  একরকম। পার্থক্য যেটা, তা হল এই যে করাচিতে ইফতারের কিছু আইটেম আলাদা ছিল। যেমন, ওখানে মুড়ির প্রচলন ছিল না বললেই চলে। কিছু কিছু বাঙালি পরিবারেই সেটা দেখা যেত। করাচিতে ইফতারে থাকত হালিম, শাহি টুকরা, ছোলা বাটোরা, রাতে প্রায় বিরিয়ানি … কিন্তু বাংলাদেশে এব্যাপারে অনেকটাই কলকাতার সঙ্গে মিল আছে। আবার ঈদের সময় ওখানে নারকেলের অভাবে নারকেল দুধের সিমাই দেওয়ারও অত প্রচলন ছিল না। যেটা বাংলাদেশ আর কলকাতায় আছে। ওখানে শুকনো খেজুর (খোরমা) দিয়ে সিরনি বেশি হত। তবে আমাদের বাড়িতে তেমন কেউ পছন্দ করত না বলে রান্নাটা শেখাও হয়নি।

পোশাকআশাকের ব্যাপারটাও সেই একইরকম। পাকিস্তানে সালোয়ার কামিজ চুড়িদার পাজামা সারারা গারারার চল বেশি ছিল। তাই আমরাও যখন যেমন ফ্যাশন চলত করতাম। শাড়ির চল ছিল না বললেই চলে। খুব মনে আছে যতদিন আব্বা ছিলেন, আমার সেজো দুলাভাই আর সেজোদিদি (আমার সেজোদিদির বিয়ে হয় কলকাতার ছেলের সঙ্গে) করাচিতেই থাকত, তারই সঙ্গে রোজার চাঁদ দেখে সন্ধ্যাবেলায় আমরা মার্কেটিং করতে বেরোতাম। জামাকাপড়ের পিস কিনতাম, সাদা ওড়না কিনে ম্যাচিং করে কালার ডাই করতে দিতাম। আমরা মানে আমি, আমার বোন আর আমার দিদির মেয়ে একসঙ্গে যেতাম। ওখানে জামাকাপড় তখন সেলাই করে পরার চল ছিল। রেডিমেড জামাকাপড় সেরকম পাওয়া যেত না। নিজেই সেলাই শিখে নিয়েছিলাম যখন, তখন আমাদের আর দাদাদের পাজামা সেলাই করে নিতাম।

বাংলাদেশে যখন এলাম, তখন বিষয়টা একটু অন্যরকম ছিল। মায়ের অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিল। তাই সংসারের সবটাই আমি দেখাশুনা করতাম। তখন ঈদ মানে ঠিক নিজেকে সাজানো গোছানোর ব্যাপারটা আর ছিল না। রান্নাবান্না, ঘর সাজানো সেইসব ব্যাপারই আমার বেশি ছিল। আবার আমি যেহেতু হোম ইকনমিক্‌স নিয়ে পড়েছি, তাই বিভিন্ন রান্নাবান্না, ঘর সাজানো আমার সাবজেক্টে ছিল। আমার পড়াশুনার সময়টা তো করাচিতেই কেটেছে। আসলে বাড়ির কাছে তখন কোনো বাঙালি মিডিয়াম স্কুল না থাকায় উর্দু মিডিয়ামেই পড়াশুনা আমার। তাই সাধারণভাবেই ওখানকার স্পেশাল কিছু রান্নাও শিখেছিলাম। যেমন শাম্মি কাবাব, নার্গিসি কোফতা, ছোলার ডালের হালুয়া ইত্যাদি। বাংলাদেশে আমার মেনুতে তখন এগুলো যোগ হয়েছিল। যেগুলো আমার মা পারতেন না, আমি করতাম। রান্নাগুলো যেহেতু আমাদের বাঙালি মুসলমানদের কাছে অপরিচিত, তাই সবাই খুব পছন্দও করত। এখন তো কলকাতায় আমার শ্বশুরবাড়িতে প্রত্যেকেই এই রান্নাগুলোকে প্রশংসা করে, শেখার চেষ্টাও করে। আমাদের বাড়িতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এগুলো একটা ফিক্সড আইটেম হয়ে গেছে।
কলকাতায় আমার জীবনের বেশিরভাগটা কেটেছে। তাই এখানকার প্রথমদিকের ঈদ আর এখনকার ঈদের মধ্যে বেশ ফারাক লক্ষ্য করতে পারি। যেমন, আমার বিয়ের পর প্রথম রোজা যেদিন শুরু হয়, সেদিন বেশ একটা ধন্দ চলছিল যে আদৌ কাল রোজা হবে কি না। আমি বললাম, মসজিদে তারাবি নামাজ পড়তে গেলেই তো জানা যাবে যে কাল রোজা কি না। কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি বললেন, ‘কে মসজিদে যাবে তারাবি পড়তে?’ খুব আশ্চর্য্য হয়েছিলাম। সেইসময় ছেলেরা নামাজ রোজা খুব একটা করত না আমাদের বাড়িতে। কিন্তু এখন প্রায় সবাই একমাস রোজা করে। নামাজও অনেকে পড়ে। আমার নিজের ছেলেমেয়েরাও খুব ছোটো থেকে একটা দুটো করে রোজা করতে করতে হাইস্কুল-কলেজে পড়ার সময় থেকে প্রায় সব রোজাই করে। আমার স্বামী অসুস্থ থাকায় করতে পারেন না। তবে মাঝে দুই তিন বছর টানা রোজা করেছিলেন। এখানে ঈদে আগে মাইকে এত গানবাজনা আলো সাজানোর চল ছিল না।

কিন্তু এখন হিন্দুদের পুজোর প্যান্ডেলের সাজসজ্জার দেখাদেখি অনেক জায়গাতেই বিভিন্নভাবে ঈদেরও প্যান্ডেল সাজানো হচ্ছে। জামাকাপড়ের ক্ষেত্রেও আগে এত বেশি কেনাকাটা করার চল ছিল না। ঈদের সময় দু-তিনটে জামা, কারো কারো একটাই জামা হত। কিন্তু এখন যাদের পয়সা আছে তাদের তো হিসেবের বাইরে, এক-একটা জামার দামই হাজার দুই-তিনের ওপর। আর যাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ, তাদেরও দেখে বোঝা যায় না যে তাদের কিছু কম আছে। কম করে পাঁচ-ছটা করে জামাকাপড় না হলে ঈদের মার্কেটিং হয়েছে বলে মনেই হয় না।