- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

জাতীয় পতাকা নামিয়ে দিয়েছে লালকেল্লা থেকে, আপনি দেখেছেন?

জিতেন নন্দী। মেটিয়াবুরুজ। ২৬ জানুয়ারি, ২০২১।#

২৬ জানুয়ারি দুপুর তিনটে নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাইকেলে যাচ্ছিলাম সন্তোষপুরের দিকে। স্টেশনের পাশে ‘কৃষক-গণতন্ত্র দিবস’-এ কৃষক শহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান ছিল। দেখি, একটা প্রায় ৩০-৪০ ফুট লম্বা জাতীয় পতাকা নিয়ে একদল যুবক এগিয়ে আসছে, মুখে তাদের শ্লোগান : ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’। কী ব্যাপার যুদ্ধ-টুদ্ধ বেঁধে গেল নাকি!

 

তারপর আমরা কয়েকজন মিলে কৃষক-শহিদদের একটা ছবিতে মালা দিচ্ছি, এমন সময় উল্টোদিকের অটো স্ট্যান্ড থেকে ভেসে এল একটা মন্তব্য : ‘জাতীয় পতাকা নামিয়ে একটা গেরুয়া না কী রঙের পতাকা তুলে দিল লালকেল্লায়। কী চলছে এসব? দিল্লি পুলিশ কি লালকেল্লাকে প্রটেক্ট করতে পারছে না। এরপর তো এখানে পাকিস্তানের পতাকা লাগিয়ে দেবে!’

 

বুঝলাম, আমার বা আমাদের উদ্দেশ্যেই এই কথাগুলো। কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘জাতীয় পতাকা নামিয়ে দিয়েছে লালকেল্লা থেকে, আপনি দেখেছেন?’

— ‘হ্যাঁ স্টার আনন্দ-এ দেখেছি। সব চ্যানেলেই দেখাচ্ছে।’

— ‘তাই নাকি? আমি তো সবে এনডি টিভি লাইভ দেখে এলাম। লালকেল্লার মাথায় তো জাতীয় পতাকা উড়ছে দেখলাম। হ্যাঁ সামনের দিকে একটা পোস্টে কৃষক আন্দোলনের একটা পতাকা উঠিয়েছে বটে। কিন্তু জাতীয় পতাকা নামিয়ে দিয়েছে, এমন তো দেখলাম না।’

 

কথা আর বেশি এগোলো না। তবে দুজনে মোবাইল নাম্বার দেওয়া-নেওয়া করলাম। ঠিক হল, আবার দুজনেই ভালো করে টিভিতে দেখে মোবাইলে কথা বলব।

সাধারণতন্ত্র দিবসে শহিদ হলেন আর একজন কৃষক, নভদীপ সিং হুন্দাল। ২৬ বছরের এই যুবক এসেছিলেন উত্তরাখণ্ডের বাজপুর এলাকা থেকে। সামান্য কিছুকাল আগেই ওঁর বিয়ে হয়েছিল। ওঁর পরিচিত আংরেজ সিং বলেন, নভদীপ ট্রাক্টর চালাচ্ছিল। পুলিশ গুলি চালানোয় ট্রাক্টর উল্টে যায় এবং নভদীপের মৃত্যু হয়। পুলিশ অবশ্য গুলি চালনার তথ্য অস্বীকার করেছে এবং সিসিটিভি ফুটেজে দেখিয়েছে যে ট্রাক্টর চালিয়ে আইটিও থেকে ইন্ডিয়া গেটের দিকে ব্যারিকেড ভেঙে আসার সময় ট্রাক্টর তিনবার পাল্টি খেয়ে নভদীপের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনা যাই হোক না কেন, দিল্লির বুকে সুপ্রিম কোর্টের সামান্য দূরে একজন কৃষকের মৃত্যু হল সাধারণতন্ত্র দিবসে।
আর একটা কথা, আজ পুলিশ বাহিনীর থেকে অনেক বেশি সংখ্যক কৃষক দিল্লির বুকে এসেছিল। যদি তারা হিংসাত্মক হয়ে উঠত, অনেক পুলিশ-কর্মী হতাহত হত। তা কিন্তু হয়নি। বরং একজন আন্দোলনকারী কৃষক আজ প্রাণ দিয়েছেন।

 

রাত সাড়ে আটটার সময় সেই অটোচালকের সঙ্গে কথা হল মোবাইলে। আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কি কখনো দিল্লিতে গেছেন? লালকেল্লা দেখেছেন?’

— হ্যাঁ।

— আপনি নিশ্চয় দেখেছেন যে লালকেল্লার তিনটে গম্বুজ। মাঝখানের সবচেয়ে বড়ো গম্বুজের মাথায় জাতীয় পতাকা থাকে। কই সেটা তো দিব্যি পতপত করে উড়ছে। আচ্ছা, বাঁদিকের যে পোস্টে কৃষকদের পতাকা লাগানো হল, সেখান থেকে কি জাতীয় পতাকা নামানো হয়েছে?

— না সেটা দেখিনি।

— তাই তো। ওই পোস্টে তো কোনো পতাকাই ছিল না। আর যদি তোলার কথা থাকত, তাহলে তো বেলা বারোটার মধ্যেই তোলা হত। (যদিও ২৬ জানুয়ারির অনুষ্ঠান হয় দিল্লির রাজপথে, লালকেল্লায় নয়। লালকেল্লার পতাকা উত্তোলন ও অনুষ্ঠান হয় ১৫ আগস্ট।)

— তা ঠিক। কিন্তু ওখানেই বা কেন কৃষকদের পতাকা তোলা হবে? সেটা কি ঠিক?

 

ইনি একজন অটোচালক। কিছুটা কংগ্রেস সমর্থক বলেই ওঁকে সকলে জানে। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, কীভাবে ১ লক্ষের বেশি ট্রাক্টরের মিছিল (আগের দিনই সরকারিভাবে এই তথ্য দেওয়া হয়েছিল।) এবং মোট ৯টি পয়েন্ট থেকে ৫ লক্ষের বেশি মানুষের শান্তিপূর্ণ দিল্লি অভিযান আড়াল করে লালকেল্লার সামনে তার এক অতি-ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের জমায়েতে সারা দেশের দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। এখন তো জানা গেছে, কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন এক ‘পান্নু’ গোষ্ঠী এবং বিজেপি এবং আরএসএস ঘনিষ্ট দীপ সিধু নামে এক যুবকের পরিকল্পিত কার্যকলাপ ছিল এটা। আর তার চেয়েও বড়ো কথা হল, সমস্ত টিভি চ্যানেল ২৬ জানুয়ারি কৃষকদের দিল্লি অভিযানের এই খণ্ড-চিত্রকেই বারবার তুলে ধরেছে টিভির পর্দায়। দুপুরবেলায় ঘটনার সাথে সাথেই এলাকায় বিজেপি-আরএসএস-এর ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ ধ্বনি তুলে মিছিল আর টিভির সংবাদ ওই অটোচালকের মনে ছায়া ফেলেছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় ওঁর মন্তব্য।