- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

গ্রামে বাড়ছে অভাবী বিক্রি। কৃষক মান্ডির হ্যাপার চাইতে চাষির ভরসা কাছের আড়ৎ।

মুহাম্মদ হেলালউদ্দিন। খড়গ্রাম। ১১ জানুয়ারি, ২০২১।#

মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহুকুমাকে বলা হয় শস্যগোলা। স্বাধীনতার পরে পরেই ১৯৪৯ সালের দিকে কান্দি মহুকুমায় রাঢ়ের ডাঙা জমিতে সেচের জন্য বড়ো বড়ো খাল কাটা হয়েছে ময়ূরাক্ষী প্রকল্পে। ম্যাসাঞ্জোরে মাটি ও পাথর দিয়ে বাঁধ তৈরি করা হয়। এই বাঁধের থেকে দু’হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি, সেইসঙ্গে ছ’লাখ একর জমির সেচ সম্ভব। মূলত বীরভূম, বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদ জেলার কিছু অংশে। সিউড়ি শহরের কাছে তিলপাড়া বাঁধ, সেখান থেকে জলের ধারা বয়ে এসেছে কান্দি মহুকুমায় সেচের জন্য ডাঙাজমির বুক চিরে। যেসব ডাঙাজমিতে চাষ ছিল বৃষ্টিনির্ভর, সেখানে ময়ূরাক্ষীর জল আসায় মাঠ সোনালি ফসলে ভরে উঠেছে। যদিও দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় জলের ধারা প্রায় ব্যাহত হচ্ছে। ঠিকমত জল পাওয়া যাচ্ছে না। এতে সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। মানুষের নিজস্ব প্রচেষ্টায় জলের ব্যবস্থা হিসাবে গভীর নলকূপে ভূগর্ভ থেকে জল তুলে চাষ হচ্ছে। তার কুফল নিয়ে মানুষের কোনো হেলদোল নেই। সরকারও উদাসীন। থাক সেসব কথা।

আমি মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহুকুমার খড়গ্রাম জেলার মানুষ। জীবিকার জন্য পড়ে রয়েছি শহর কলকাতায়। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহটি কাটিয়ে এলাম নিজের গ্রামে। ধানের অভাবী বিক্রি খুব বাড়ছে আজকাল। এবারে ধানের সহায়ক মূল্য ১,৮৬৮ টাকা। তবে এই সুবিধা পাচ্ছে না সব চাষিরা। উৎপাদিত ধানের তুলনায় কম ধান কেনা হচ্ছে। গতবছরে প্রতিটি পঞ্চায়েতে ধান কেনার ব্যবস্থা হয়েছিল। এবারে শুধু ব্লকের কৃষিমান্ডিতেই ধান কেনা হচ্ছে। কেনার কেন্দ্রগুলোর দূরত্ব বেশি। কোথাও ৩০-৩৫ কিলোমিটার। বালিয়া অঞ্চলের মানুষকে আসতে হচ্ছে নগরে, যার দূরত্ব ৩০-৩৫ কিলোমিটারেরও উপরে। বহনখরচা অনেক। তারপর শাসকদলের বাইরে যারা আছে তাদের অবস্থা আরও করুণ। স্বজনপোষণ তো আছেই। গেলেই কিন্তু ধান নেওয়া হয় না। চাষিদের নাম লিখে রেখে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে ডেকে নেওয়ার। সেখানেও নানা অব্যবস্থা। ধান ওঠার পরে পরেই রবিশস্য চাষের হিড়িক পড়ে যায়। গম ও খরা মরশুমের ধানচাষ শুরু হয়। প্রয়োজন হয় নগদ টাকার। তখন চাষি বাধ্য হয় ধান বিক্রি করতে। যাকে বলা হয় অভাবী বিক্রি। সরকারকে বিক্রি করলে টাকা পেতে দেরি হয় অনেক। আর গ্রামে গ্রামে গজিয়ে ওঠে ধান কেনার আড়ৎ। এখন খোলা বাজারে ধানের দাম বারশো পঞ্চাশ টাকা প্রতি কুইন্টাল। চাষি বাধ্য হচ্ছে এই বারশো পঞ্চাশ দরেই। এই অভাবী বিক্রি আটকাবে কে? উৎপাদিত ধানের সবটা কেনার ব্যবস্থা কোনো বছরেই হয় না। এবারেও হয় নি।

কান্দুরী গ্রামের ইদুল সেখ। তার কোনো জমি নেই। পরের জমি ঠিকায় নিয়ে চাষ করে। সার, লেবার সবকিছু তাকেই দিতে হয়। তার বক্তব্য, ‘ধান উঠল, ধান ভালোই ফলেছে। কিন্তু দাম কোথায়? সাড়ে বারশো টাকা কুইন্টাল। কিছুটা পেঁয়াজ লাগাব আর ধানচাষ করব। এত কম দামে ধান বিক্রি করে লাভ নেই’। আমি তাকে বলি, কেন কৃষিমান্ডিতে তো দাম বেশি? – ‘কৃষিমান্ডিতে ধান দেব বললে তো হবে না। গেলে তো নিবে না। স্লিপ ধরে দিবে। তাও গেলেই যে স্লিপ পাবে, তা’ও না। তারপর কবে ডাক আসবে, কবে টাকা পাব, তার ঠাঁইঠিকানা নেই। যার জন্য বাধ্য হয়ে চরণবাবুদের আড়তে দিয়ে এলাম সাড়ে বারশো কুইন্টালে। তারপর ধলতা কেটে নিল। কুইন্টালে চার কেজি, মানে পঞ্চাশ টাকা বাদ। হাতে পেলাম কুইন্টাল প্রতি বারশো টাকা। বিষ-সারের খুব দাম। তারপরে, একাই তো চাষ করতে পারি না, লেবার নিতে হয়। ট্রাক্টর ভাড়া, সেচের পানি- সব মিলিয়ে অনেক খরচ। আরো নগদ টাকা দরকার। আমরা অভাবী মানুষ। আমাদের নগদ টাকা কোথায়? তাই বাধ্য হতে হয় বিক্রি করতে। সরকারের রেটে ধান বিক্রি করার নানান হ্যাপা’।



আগে কখনো এভাবে এত লোকের সামনে বলেননি শেখ ওসমান। আজ বললেন। বললেন কৃষকদের সমস্যা কীভাবে বাকিদেরও সমস্যা হয়ে ওঠে। কীভাবে সিংঘুতে অবস্থানে থাকা পাঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকদের স্বার্থ মহেশতলার দর্জিদের স্বার্থের সঙ্গে মিলেমিশে যায়।
এভাবেই মহেশতলার সন্তোষপুর স্টেশনে হওয়া শনিবারের এই সংহতি সভা আলাদা হয়ে ওঠে। স্থানীয় বিভিন্ন ছোটো পত্রিকা, কবি-শিল্পী-সাহিত্যকর্মীদের যৌথ উদ্যোগে এই সভা। উদ্দেশ্য কেন্দ্রের ৩ কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো। এবং গান-কবিতা-বক্তৃতা-নাটক-শ্লোগানে সেই কথাটাই বারবার জানানো। সমস্বরে বলা, ‘জো অন্নদাতা সে টকরায়েগা, চুরচুর হো জায়েগা’।
শেখ ওসমান যে-শ্লোগানে খুঁজে পেলেন নিজের স্বর। আরও অনেক মানুষ যে-স্বরে গলা মেলালেন।
—ছবি ও প্রতিবেদন- শোভন চক্রবর্তী


সাগরের বিঘা দুই জমি। নিজে চাষ করে না। তৃণমূলের সমর্থক, গরুর হাতুড়ে ডাক্তার- এভাবেই দিন গুজরান। তার ঘরে বসে কথা হচ্ছিল। তার কথাবার্তায় তৃণমূলের দিকে বড়োই টান। তাকে বলি, সরকার তো অভাবী বিক্রি আটকাতে পারছে না। কৃষিমান্ডিতে স্লিপ নিতেই লম্বা লাইন। কবে ডাক আসবে- তাও বিশ বাঁও জলে। তবে চাষি যাবে কোথায়? সরকারের রেটের চাইতে খোলা বাজারে দামের হেরফের দুশ টাকার ওপরে। – কোনো সদুত্তর নেই। পাশের লোকটা বলে উঠল, ‘দলের টান টেনে সাগরভাই কথা বলছে। অভাবী বিক্রি আটকানোর সরকারি পলিসি কই? ধানের দাম কোথায় খোলা বাজারে? আড়তের সুবিধা, নিয়ে গেলেই ওরা নিয়ে নেবে। টাকাও দিবে হাতে হাতে। সরকারি মান্ডিতে টাকা কবে পায়? তারপরে আমাদের এখান থেকে ব্লকে অর্থাৎ নগরে যেতে হবে। রাহা খরচ। নানা হ্যাপা। আড়ৎ তো গাঁয়েই। মাথায় করে নিয়ে যেতে পারি পঞ্চাশ কেজি। দু’বারে একশ কেজি। নগরে তো তা নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সেখানেও ধলতা (বাটা বা খাদ) নিবে’।

খাদ কিসের ভিত্তিতে নিচ্ছে তার কোনো যুৎসই উত্তর মেলে না। ‘নেতা বা দালাল মারফৎ মান্ডিতে গেলে সুবিধা পাওয়া যায়। সহজে বিনা লাইনে স্লিপ আসে তাড়াতাড়ি। ডাক আসে তাড়াতাড়ি। টাকাও পাওয়া যায় তাড়াতাড়ি। সবার সে সৌভাগ্য হয় না। কাটমানির ফাঁড় ও কত কী সব আছে। তুমি তো শহরে থাকো। সবকিছু অত ডিটেলে জানো না’। ইদুল, সাগর শুধু নয়। সবার গড়পরতা কথা একই রকম। বিশেষ হেরফের নেই। তারপর উড়ে এসে জুড়ে বসেছে কেন্দ্রিয় সরকারের কালা কৃষিকানুন। কেন্দ্রিয় সরকারের কালা কানুন নিয়ে গ্রামে হেলদোল নেই। খুব কম মানুষ জানে বিষয়টা।