- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘যদি প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ নিজেরাই তৈরি করতে পারি …’

অমৃতা মুখার্জি, খড়দহ, ১৮ ডিসেম্বর#

চারিদিকে আমরা এখন শুনি জলবায়ুপরিবর্তন। এই কিছুদিন আগে প্যারিসে বিশ্বের ১৯৫টি দেশের প্রায় ৪০,০০০ প্রতিনিধি জলবায়ুপরিবর্তন ও সেই সংক্রান্ত নানা বিপদ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছেন। এ’বারের সন্মেলনের লক্ষ্য পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে ওই বৃদ্ধির হার শিল্পবিপ্লবের সময়ের তুলনায়, একুশ শতকে, কোনও ভাবেই ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড অতিক্রম করে না যায়।

মানুষ যেদিন প্রথম আগুণ আবিষ্কার করেছিল, সেদিন সে প্রথম বন কেটে চাষ-আবাদ করেছিল সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে তার জেহাদ এবং এই জেহাদই ধীরে ধীরে বিপ্লবের আকার নিয়েছে – কয়লা ও খনিজতেল আবিষ্কারের পর। গড়পড়তা ধীর জীবনে এসেছে গতি, এই তো উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার কথা মানুষ গরুর গাড়ি চড়ে ১০ কিমি যাত্রা করতে সময় লাগত ১০ ঘন্টা। স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর কয়লা পুড়িয়ে তা হল ২৫ কিমি/ঘন্টা। মানুষের জীবনে আর একবার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এল বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর। কয়লা পুড়িয়ে খনিজ তেল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন হওয়ার পরেই আমরা ধীরে ধীরে আমরা যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম – কমপিউটার থেকে ল্যাপটপ ও ট্যাবের দুনিয়া আর সাধারণ পাখা থেকে এয়ার কন্ডিশন-এর জগতে। আমাদের মুঠির মধ্যে আছে স্মার্ট ফোন। যার মাধ্যমে জগত সংসারের বিশাল দুরত্বের খবর আম জনতার গোচরে চলে আসছে।

কিন্তু আমাদের জীবনের এই দুর্নিবার গতিতে অগ্রসর হওয়ার খেসারত দিতে হয়েছে পরিবেশকে। আমাদের দেশে প্রথম জলবিদ্যুৎ তৈরি হয় ১৮৯৬ সালে, দার্জিলিং থেকে ১২ কিমি দূরে সিওরাপং-এ। সেই থেকে যাত্রা শুরু। আমাদের দেশে বর্তমানে যে বিদ্যুৎশক্তি তৈরি হয় তার ৫৭% (কয়লা পুড়িয়ে) আসে তাপবিদ্যুৎ থেকে। ১৮% আসে জলবিদ্যুৎ থেকে, ১২% আসে (সৌর শক্তি ও অন্যান্য), ৩% (পারমাণবিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র) ১% (খনিজ তেল থেকে)।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে চিত্রটি হল ৯৭% আসে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আর ৩% আসে সৌরশক্তি ও অন্যান্য থেকে।
কিন্তু আমরা কি জানি আমরা যে শক্তি ব্যবহার করি তার এক ইউনিট শক্তি উৎপন্ন করতে ১.৫ কেজি কয়লা পোড়াতে হয়? কয়লা পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন করা মানে প্রচুর পরিমাণ গ্রীন হাউজ গ্যাস উৎপন্ন করা। বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইড  আর কার্বন মনো অক্সাইডএর পরিমাণ বাড়ানো। সূর্য থেকে আগত তাপশক্তি এই কার্বন কণাগুলিকে শোষণ করে, ফলে পৃথিবীর বায়ুস্তরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে ও ফলশ্রুতি বিশ্বের উষ্ণায়ী ও জলবায়ুর পরিবর্তন। ১৮৮০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে পৃথিবীর জলস্থানের গড় তাপমাত্রা প্রায় ০.৮৫ সেলসিয়াস বেড়েছে। সমগ্র জীবকূল আজ বিপন্ন, অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে, অনেক প্রাণী বিলুপ্ত প্রায়। প্যারিস ক্লাইমেট সামিটে ভারত ঘোষণা করেছে, ২০০৫ সালের নিরিখে ২০৩০ সালে কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ৩৩ থেকে ৩৪ শতাংশ কমিয়ে ফেলা হবে। বনাঞ্চলের প্রসার ঘটিয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোধনের ব্যবস্থা করা হবে।

বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যা৭০০ কোটির কাছাকাছি। আর এখন বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। আমাদের দেশে ১৫০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৩০ কোটি মানুষ এখনো বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহারের সুযোগ পায়নি।
সমস্যা থাকলে তার সমাধানও আছে। একমাত্র সমাধান হলো অপ্রচলিত শক্তির উৎসকে ব্যবহার করা। যেমন, সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি (wind energy), জোয়ার-ভাটা থেকে উৎপন্ন শক্তি (tidal power), বায়ো মাস ও বায়ো ফুয়েল, ভূ-তাপ (geothermal energy)। যদিও ভারতে ভূ-তাপ শক্তির উৎস প্রায় নেই বললেই চলে।

প্রথম সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎশক্তি আবিষ্কার করেন আলেকজান্ডার এডমন্ড ব্যাকুরেল, ১৮৩৯ সালে। তার ১০০ বছর পরে ১৯৪১ সালে রসেল ওল প্রথম বিদ্যুৎ কোষ (solar cell) তৈরি করেন। কিন্তু এত বছর আবিষ্কারের পরেও সৌরশক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে উৎপন্ন করার পদ্ধতি তেমনভাবে প্রাধান্য পায়নি। উনিশ শতকের শেষের দিকে একদল মানুষ প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অবমাননা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পরেন। মানুষের নজর যায় পরিবেশের পরিবর্তনের বিষয়গুলোর ওপর। পরিবেশের প্রতি সজাগ হওয়ার পরই প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরের ওপর জোর দেওয়া হয়। এবং খুব ধীর গতিতে শুরু হয় প্রাকৃতিক শক্তির ব্যবহার ও শক্তির দক্ষতা (energy efficiency)।

এই শতকের প্রথম দশকে ছোটো সোলার গ্রিড প্রথম বসানো হয় সুন্দরবনে। ২০০৯ সালে প্রথম সৌরবিদ্যুৎকে গ্রিডের সাথে যোগ করা হয়। প্রথম ‘জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল সোলার মিশন’ (JNNSM) চালু হয় ২০১০ সালে। প্রথম ধাপে সৌরশক্তি উৎপাদনের লক্ষ্য রাখা হয় ১১০০ মেগাওয়াট। অধুনা ভারত সরকার ২০২২ সাল পর্যন্ত এক লক্ষ মেগাওয়াট সৌরশক্তি ব্যবহারের লক্ষ্য রেখেছে (এবং এর জন্য ছয় লক্ষ পর্যন্ত মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলা হচ্ছে)।

আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো জলবায়ু পরিবর্তন আর আতঙ্কবাদ। আতঙ্কবাদের মূল কারণ হচ্ছে খনিজ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর ওপর চাপ, দাবি ও তার জন্য বিশ্ব রাজনীতি। আমরা যদি প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ নিজেরাই তৈরি করতে পারি তবে হয়তো আমরা আগামী প্রজন্মের কাছে এক সুন্দর বিশ্ব রেখে যেতে পারবো।