- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

একজন পেশাদার ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত, চোখে আঙুল দিয়ে শেখাতেন বিমল সেন

 

অর্জুন সেনগুপ্ত। কলকাতা। ১১ অক্টোবর, ২০২০।#

 

ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (নবপর্যায়)—এর ভূতপূর্ব সভাপতি কমরেড বিমল সেন ১০/১০/২০২০ দ্বিপ্রহরে প্রয়াত হলেন, পেছনে রেখে গেলেন এক বিরল সংগ্রামী ঐতিহ্য। ষাটের দশকে বিমল সেন রাজ্য সরকারের পি ডব্লিউ ডি দপ্তরে গ্রুপ ডি কর্মচারী হিসাবে যোগ দেন। যাদের ধারণা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা স্বল্প মেধার হন, বিমলদার দৃষ্টান্ত তাদের ভুল প্রমাণিত করে। ছোটবেলা থেকেই বিমলদা মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পরবর্তীতে ‘সংগ্রামের সাথী’র(সংগঠনের মুখপত্র) প্রুফ রিডিং ও বক্তৃতার সময় তাঁর শব্দ চয়ন এই সত্যটির পরিচয় রাখে। তার বক্তব্য ছিল সাবলীল ও তথ্য সমৃদ্ধ। সংগঠনের হিসাব রক্ষক হিসাবেও তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। পরিবারের আর্থিক অনটন তার পুঁথিগত শিক্ষার ইতি টানে অচিরেই। বন্ধু বিমল চাকরি জীবনের শুরুতে সিপিএম পরিচালিত কো-অর্ডিনেশন কমিটির অন্তর্গত নিম্নতম কর্মচারী সমিতির সদস্য ছিলেন। তবে ওই পার্টির সদস্য বা সমর্থক ছিলেন এমন কোনো তথ্য নেই। তিনি কো-অর্ডিনেশন কমিটির সংগ্রামী নেতৃত্ব অমল গাঙ্গুলির অনুসারী ছিলেন। সাতষট্টি সালে নকশালবাড়ি কৃষি বিদ্রোহের পর কো-অর্ডিনেশন কমিটির অভ্যন্তরে সংগঠনের মত পথ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। অমল গাঙ্গুলি, বিমল সেনের মতো সংগ্রামী ব্যক্তিত্বরা কৃষকদের উপর যুক্ত ফ্রন্ট সরকারের গুলি চালনার তীব্র বিরোধিতা করেন। উপর মহলের সঙ্গে শুরু হয় সংঘর্ষ। ‘৭০ সালে বিরাট সাড়া জাগিয়ে নিম্নতম কর্মচারী সমিতি কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাথে তাদের বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করে। বিমলদা সেই স্বাধীন সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। কেটে যায় অনেক সময়। এরপর ‘৭৭ সালে যখন তথাকথিত বামেরা রাজ্যের সরকারি ক্ষমতায় এসে বন্ধু সরকারের তত্ত্ব হাজির করে তখন অমল গাঙ্গুলির সাথে কো-অর্ডিনেশন নেতৃত্বের বিরোধ তীব্রতম রূপ ধারণ করে। নতুন সংগঠন তৈরির প্রেক্ষাপট প্রস্তুত হয়। অমল গাঙ্গুলি, রবি বোস, ফটিক দে, নিমাই হুঁই মজুমদার সহ সারা রাজ্যের বহু সংগ্রামী নেতৃত্ব ও কর্মীরা গঠন করেন ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, পরবর্তীতে যা নবপর্যায়ে উন্নীত হয়। বলা বাহুল্য লড়াইয়ের আধার চয়নে ভুল হয়নি বিমল সেনের।

যতদূর মনে পড়ে দিনটা ছিল ১০ মার্চ ১৯৯৮, মিউনিসিপ্যাল অ্যাফেয়ার্স দপ্তরের আমাদের ছয়জন সদস্যকে অন্যায় ভাবে সাসপেন্ড করা হয়েছে। মহাকরণে সংগঠনের তুমুল বিক্ষোভ। দপ্তরের মন্ত্রী অশোক ঘোষ, সচিব অশোক মোহন চক্রবর্তী। নবপর্যায় নিয়ম মানার সংগঠন নয়। বিক্ষোভ মিছিল ঢুকে গেল রাইটার্সের সংরক্ষিত এলাকায়। যেখানে বসে মন্ত্রী, আমলার দল। সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ধুন্ধুমার। পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে এলো রে রে  করে। আমরা যারা যুবক তখন, ঝাঁপিয়ে পড়লাম পুলিশের উপর। ইতিহাস । মহাকরণে এই প্রথম পুলিশ কর্মচারী সংঘর্ষ। খেয়াল করিনি কখন আমাদের পাশে এসে গেছেন ষাট ছুঁই ছুঁই বিমলদা। যা হবার তাই, লাঠির ঘায়ে হাত ভাঙলো তার। রবিদা, বিমলদা, সন্দীপ, অনিরুদ্ধ, জয়গোপাল অ্যারেস্ট। জয় বাদ দিলে সবাই গুরুতর আহত। এই আমাদের বিমলদা।

অনাহার, দারিদ্র্যের অভিঘাতে টিবি হয়েছিল যুবক বয়সেই। তারপর থেকেই নানা অসুখকে টেনে নিয়ে চলতেন বিমলদা। তবে সংগঠনের কাজে অন্তরায় হতোনা সেসব। একজন পেশাদার ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা চোখে আঙুল দিয়ে শেখাতেন তিনি। অবসরের পরও যে একজন সংগঠন অন্ত প্রাণ হতে পারে বিমলদাকে না দেখলে বিশ্বাস হবেনা। হিসাব রক্ষক হিসাবে বা পরে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন দৃষ্টান্তমূলক ভাবে। কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যতদূর জানি যোগাযোগ ছিল না তার। তবে দেখেছি কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের প্রতি অপার শ্রদ্ধা আর চোখে ভারতের মুক্তি সংগ্রামের স্বপ্ন। মুখে অবশ্য অবিরাম আউড়ে যেতেন সংগঠনের মূল মন্ত্র – ‘এই ব্যবস্থায় কোনো সরকার কর্মচারী, মেহনতি মানুষের বন্ধু হয়না’। একটা খুব বাজে অভ্যাস ছিল বিমলদার, হাঁটুর বয়সী থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ সবাইকে ‘দাদা’ সম্বোধন করতেন। হাজার বার বারণ করলেও শুনতেন না। পরে বুঝেছি সংগ্রামী সাথীদের ওটা তার স্বীকৃতি।

খুব আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন বিমলদা। সংগঠনে উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে। আমাদের মতো বহু মত পথ বিশিষ্ট সংগঠনে তা মাঝেমধ্যেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কান্নায় ভেঙে পড়তেন বিমলদা। ভীষণ ভয়, সংগঠন যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়! আকুল আবেদন করতেন, ‘আপনারা সংগঠনটা ঠিক রাখুন’।

এই অতিমারীর পরিস্থিতিতে এমনই অবস্থা যে বিমলদার মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারলাম না, তাকে সংগ্রামী বিদায় জানানো তো দূর অস্ত। এই লেখার মধ্যে দিয়েই বিদায় জানাই প্রিয় সাথীকে।