- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

বিজ্ঞানের শিক্ষা থেকে শিক্ষার বিজ্ঞান – চর্চার গোটা পথে একজন কান্ডজ্ঞান না-হারানো মানুষ দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী

সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা। ৩০ অক্টোবর, ২০২০।#
শ্রমজীবী বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী। চিরকাল উনি গরীব মানুষের বস্তিতে গিয়ে গিয়ে তাদের লেখাপড়া শেখাতেন

পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী ১৯৬০ দশকের শেষে নকশালপন্থী আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। তারপর উচ্চতর অধ্যায়নের জন্য তিনি বিদেশ চলে যান এবং দেশে ফিরে এসে কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। গত কয়েকবছর ধরে তিনি খুবই অসুস্থ ছিলেন ; কিন্তু সজীব ছিল তাঁর শিক্ষকসত্তা। বছরদুয়েক আগেও তিনি যাদবপুরে শিক্ষাবিষয়ে একটি আলোচনাসভায় যোগ দিতে এসেছিলেন।

দীপাঞ্জন রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ১৯৮৪ সালে, এপিডিআর মানবাধিকার সংগঠনে কাজের সূত্রে। তখন দেখেছি, তাঁর নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক-না কেন, একটি মানবাধিকার সংগঠনের রাজনীতি তিনি নিষ্ঠাভরে মেনে চলতেন। সভায় কেউ হয়তো উত্তেজনার বশে একটু উগ্র রাজনৈতিক মন্তব্য করে ফেলেছে, দীপাঞ্জনদা তাকে স্মরণ করিয়ে দিতেন, গণতান্ত্রিক সংগঠনের মঞ্চ থেকে এধরণের কথা বলা যায় না। মতভেদের কারণে সভা উত্তপ্ত হয়ে উঠলে দীপাঞ্জনদা শান্তভাবে বিবাদ মিটিয়ে দিতে চাইতেন। তাঁর ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা না-করে উপায় ছিল না।

১৯৮৪ সালের শেষ দিকে কলকাতার পথবাসী ঝোপড়িবাসী মানুষদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে : ‘ছিন্নমূল শ্রমজীবী অধিকার সমিতি’। আমি তার সক্রিয় সদস্য ছিলাম দু-বছর।

দীপাঞ্জনদা সদস্য না হলেও প্রথমদিকে সংগঠনের সভায় আসতেন; মন দিয়ে আলোচনা শুনতেন, কখনো বা পরামর্শ দিতেন। এইসময়ই তাঁর মনে হয়, পথবাসী বা বস্তিবাসী শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কিছু কাজ করা যায়। তিনি আমাকে তাঁর ভাবনার কথা বলেন। সেটা ১৯৮৫ সাল।

দীপাঞ্জনদার সঙ্গে এবার আমার পরিচয় আরো নিবিড় হয়। কসবা অঞ্চলের একটি বস্তিতে আমরা কাজ শুরু করে দিই। ততদিনে দীপাঞ্জনদার ডাকে আরো কয়েকজন এসে গেছেন। পাওলো ফ্রেয়ারের শিক্ষাচিন্তায় অনুপ্রাণিত আমরা অন্যধরনের শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রায় তিন বছর আমি এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তখন দেখেছি দীপাঞ্জনদার গভীর নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা।

আমরা প্রত্যেকেই চাকরি বজায় রেখে এই কাজে সময় দিচ্ছিলাম। সবাই যে সমান আন্তরিক ছিলেন, তা নয়। কিন্তু দীপাঞ্জনদার কখনো ক্লাসে আসতে ভুল হতো না। অথচ তখনই কিন্তু তাঁর শরীরে নানারকম সমস্যা ছিল। শুধু বিস্কুট খেয়েই কাটিয়ে দিতেন ঘন্টার পর ঘন্টা।

দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী কর্মজীবনের শেষ দিকে প্রেসিডেন্সী কলেজে এসেছিলেন। তার আগে পড়াতেন আচার্য জগদীশচন্দ্র কলেজে। একদিন তাঁর সঙ্গে কসবায় আমাদের কাজের বিষয়ে আলোচনার জন্যে সেই কলেজে যাই। দীপাঞ্জনদা’ই সময় বলে দিয়েছিলেন। দেড় ঘন্টা হয়ে গেল আমি বসে আছি; তাঁর ক্লাস আর শেষ হয় না। পরে যখন এলেন , এতটুকু বিব্রত নন। বললেন, ‘এরকম তো হতেই পারে’। তিনি যে কতখানি নিষ্ঠাবান শিক্ষক, সেদিন বুঝেছিলাম। প্রেসিডেন্সি থেকে অবসরগ্রহণের পরও তিনি দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী স্কুলে কয়েকবছর পড়িয়েছিলেন।

দীপাঞ্জনদার সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে মতভেদ হয়েছে, মনোমালিন্যও ঘটেছে। তাঁকে আমি বরাবরই শ্রদ্ধা করে এসেছি। দীপাঞ্জনদাও ক্রমে আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে ওঠেন। সম্ভবত তিনি আমার কাজের খোঁজ রাখতেন। আমার একটা বই পড়ে উৎসাহিত হয়ে তিনি একবার আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন, ওই বিষয়ে আরো কিছু জেনে নেবার উদ্দেশ্যে। অনেক গল্প হয়েছিল সেদিন। নন্দীগ্রাম পর্বে আমরা একসঙ্গে মিটিং করেছি।

দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন বলে শুনেছি; কিন্তু আমার পড়া হয়নি। তিনি বেশ কয়েকবছর ধরেই গুরুতর অসুস্থ ছিলেন; ২৪ অক্টোবর ভোররাতে তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বেদনা বোধ করছি।

 

মানবাধিকার কর্মী তপন বসুর সংযোজন

প্রয়াত দীপাঞ্জন রায়চৌধুরীর সঙ্গে ১৯৭৮ সাল থেকে পরিচিত হই। মূলত মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর এ কাজের সূত্রে। দেশ জুড়ে অধিকার রক্ষার দাবীতে ১৯৮৩ সালে কলকাতা থেকে দিল্লী যে সাইকেল র‍্যালি সংগঠিত হয়, তাতে দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী খুব সক্রিয় ভাবে অংশ নেন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল।