- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

বাঙালোরের মুসলমান এবং মাহে রমজানের দিন

কামরুজ্জামান, বাঙালোর, ১৪ জুলাই#

বাঙালোরের মুসলমানরা ধর্মপরায়ণ এবং নিষ্ঠাবান মানুষ। এখানকার মুসলমানরা নবাব হায়দার আলি খান এবং নবাব টিপু সুলতানকে ভুলে যায়নি। তাই তারা নবাব টিপু সুলতানের ২১৪ তম শহিদ দিবস মহা আড়ম্বরের সহিত স্মরণ করেছে। নবাব টিপু সুলতানকে কর্ণাটকের মুসলমানরা হজরত টিপু সুলতান বলতে বেশি পছন্দ করে।
বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজরা হারিয়ে যে সমগ্র ভারত জয়ের সূচনা করেছিল, তা মহীশূরের নবাব টিপু সুলতানকে ১৭৯২ সালে তৃতীয় ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধে ইংরেজরা গুলিবিদ্ধ করে। টিপু সুলতান বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে শহিদ হয়ে যান। তাঁর মাথায় গুলি লেগেছিল। কিন্তু তাঁর হাতের তরবারি পড়ে যায়নি। তরবারিটি উঁচু করে ধরেছিলেন ইংরেজের বিরুদ্ধে তখনও — বললেন পরভেজ অটোওয়ালা। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার হার এবং মহীশূরের নবাব টিপু সুলতানের শহিদ হওয়ার মাধ্যমে ইংরেজরা ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত বিজয়ের বৃত্ত পরিপূর্ণ করেছিল।
আমি, আমার স্ত্রী, আমাদের দুই শিশু ছেলে আমির এবং শাহী — আমরা আছি বাঙালোরের কলাসিপলয়মে। কলাসিপলয়ম একটা বড়ো বাসস্ট্যান্ড। আমাদের মেছেদা বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় ছয় গুণ বড়ো। প্রচুর লোকাল এবং দূরপাল্লার বাস এখান থেকে ছাড়ে। চেন্নাই, মুম্বই, কোচি — হাজার রুটের বাস এখান থেকে প্রতিনিয়ত চলছে রাতদিন। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডটা নোংরা এবং ক্যাচরাতে ভর্ত্তি। নেই কোনো মাথার শেড। বৃষ্টি হলে যাত্রীদের ভেজা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আছে শুধু ঘন ঘন সুলভ শৌচালয় এবং ঘন ঘন মদের দোকান। এত মদের দোকান আমি ভারতের অন্য কোনো শহরে দেখিনি। এটা হচ্ছে বাঙালোর।

এই কলাসিপলয়মে প্রচুর বড়ো বড়ো মসজিদ আছে। প্রতিটি মসজিদের সঙ্গে প্রাইমারি এবং আপার প্রাইমারি স্কুল আছে। কোথাও উর্দু, কানাড়া এবং ইংরেজি পড়ানো হয়। আবার কোনোটা পুরো ইংলিশ মিডিয়াম, তাই এখানকার মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা উর্দু, কানাড়ার সঙ্গে একদম ইংলিশেও জুয়েল। কলিমভাই বলেন, কলাসিপলয়ম এবং শিবাজীনগরে বেশিরভাগ মুসলিম লোক বাস করে। কিন্তু পলিটিশিয়ানরা মুসলমানদের ডিভাইড করে রাখে। এখানকার কংগ্রেসের বড়ো নেতা কে আর রহমান খান। গত টার্মে রাজ্যসভার ডেপুটি স্পিকার ছিলেন, কিন্তু তিনি ভালো কিছু কাজ করেননি বাঙালোরের জন্য। বাঙালোরের আবহাওয়া অনেক ভালো। এখানে রোজা রাখলে, আমাদের ওখানকার শীতকালের মতো মনে হয়। এখানে তেমন গরম নেই। আবার একদম ঠান্ডাও নেই। চিরবসন্ত এখানে। তাই রোজা রেখে মানুষ নিজের কাজ সারাদিন মহানন্দে করতে পারে। আমি নিজে বিভিন্ন কারণে রোজ দশ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি করি, একটা ঘাম পর্যন্ত দেয়নি গায়ে, আর তেষ্টাও পায়নি।
অটোওয়ালা বাবুভাই-এর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বাবুভাই বলে, কর্ণাটকের মুসলমানরা এত আল্লার এবাদত করে। তাই কর্ণাটকের ওপর এখনও পর্যন্ত বড়ো কোনো বিপদ আসেনি। তাই আল্লার ইচ্ছায় বিজেপির শাসন হটিয়ে এখানে কংগ্রেস আবার ফিরে এসেছে ক্ষমতায়। ‘টোয়েন্টি পারসেন্ট মুসলমান কি এবাদত আল্লানে মঞ্জুর কিয়া তব তামাম লোগ মিলকে বিজেপি কো হটায়া।’ কর্ণাটকের সমস্ত মানুষ শান্তি চায়। শান্তিতে পাশাপাশি বাস করতে চায়, কোনো ঝামেলা চায় না। তাই এখানে একটা মুসলিম বাড়ির পাশেই দেওয়াল ঘেঁষে একটা অমুসলিমের বাড়ি। একে অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবসময়। এত সুমধুর সম্পর্ক মুসলিম এবং অমুসলিমের মধ্যে অন্য কোথাও আছে বলে আমার মনে হয় না। কলিম তেলওয়ালা বলে, দক্ষিণে কেরালা, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মানুষরা শান্তিপ্রিয়, সে যে কোনো জাতির হোক না কেন। কুড়ি বছর আগে বাঙালোর আরও অনেক ভালো ছিল। এখান শহর বাড়ছে, বিভিন্ন রাজ্য থেকে লোক আসছে। ‘প্রচুর বাঙালি লোগ ভি আয়া। থোড়া ক্রাইম ভি বড়া। ফিরভি বাঙালোর বাঙালোরই হ্যায়।’ রোজামাসের জন্য সমস্ত মুসলিমদের দোকান সন্ধ্যে ৬টায় বন্ধ হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হল, তার সাথে সাথে অমুসলিমদের দোকানও বন্ধ হয়ে যায়। এফতারের সময় হয়ে এলে, আকাশের অনেক উঁচুতে একটা বোম ফাটে। তারপরই মসজিদে মসজিদে রোজা খোলার নিয়ত পড়া হয়। তার পাঁচ মিনিট পর আজান হয়। সমস্ত মুসলিম আল্লার হুকুম পালন করে রোজা খুলে আল্লার এবাদতে মসগুল হয়ে পড়ে।
আজ সোমবার এখানে রোজা খোলার সময় হচ্ছে ৬.৫০ মিনিট। এফতারির সময় হয়ে আসছে, তখনই আকাশের অনেক উঁচুতে বোমাটা ফাটল। কলাসিপলয়ম সহ গোটা বাঙালোর সুমধুর আজানের আওয়াজে ভরে গেল। বইতে শুরু করল ঠান্ডা কল্লোলিত সুবাসিত বাতাস। একমাত্র রমজান মাসই এত কিছু বয়ে আনতে পারে রোজাদারদের জন্য। তামাম বিশ্বমানবের জন্য!