- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

স্বশাসিত বোড়োভূমিতে অ-বোড়োদের বঞ্চনার পথ ধরে জাতিদাঙ্গা

বিজয়া কর সোম, শিলচর, ৩১ জুলাই##

বোড়োভূমিতে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা আপাতত শিবিরে আশ্রিতদের পুনর্বাসন। ঘরবাড়ি জ্বলেছে, গ্রামের পর গ্রামের অস্তিত্বই নেই। সরকারি হিসেব বলছে, ২৭০টি শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে ৩.৯২ লক্ষ মানূষ। এত বিশাল সংখ্যাক মানুষের পুনর্বাসন কি সম্ভব? কোকরাঝাড়-বঙ্গাইগাঁওয়ের প্রায় দু-দশক আগের শরণার্থী সমস্যা আজও সমাধান করে উঠতে পারেনি সরকার। ১৮ বছর আগে জাতিদাঙ্গার শিকার ১৩৭৫টি পরিবার এখনও পুনর্বাসনের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৩, ১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালে অবিভক্ত কোকরাঝাড় জেলা ও বঙ্গাইগাঁওয়ে জাতিদাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় মোট ১১,৬৭৪টি পরিবার। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে দাঙ্গাকবলিত জায়গাগুলি ঘুরে গেছেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আর্থিক সহায়তার। কিন্তু দাঙ্গার মূল কারণ কী তা দেখবেন না প্রধানমন্ত্রী? এর আগেও দাঙ্গা হয়েছে। কেন্দ্রের তরফ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এরপরও ঘটে গেল এবারের দাঙ্গা। এখনও যদি দাঙ্গার সঠিক কারণ বের না করে শুধু আর্থিক সহায়তার কথা বলে কেন্দ্রীয় সরকার এই অধ্যায়কে বন্ধ করে দেন, তাহলে ভবিষ্যতে আরও দাঙ্গা ঘটবে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
এই গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের পেছনে আদতে রয়েছে আর্থ-সামাজিক অনুন্নয়ন ও বঞ্চনার ক্ষোভ। বোড়ো টেরিটরি তথা নিম্ন আসামের জেলাগুলিতে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে পা দিলে দেখা যায় চারদিকে শুধু হাহাকার। পথঘাট-স্কুল-স্বাস্থ্যকেন্দ্র-বিদ্যুৎ-কলকারখানা-হিমঘর ইত্যাদি কিছুই নেই। অধিকাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার। গত ছয় দশকে তাদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। অনেকেই পেটের তাগিদে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে গৌহাটির রাজপথে রিক্সা-ঠেলা চালায়, সব্জি ফেরি করে, ভাঙা লোহা-লক্কড় যোগাড় করার মতো কাজ করছে। অথচ এই নিম্ন আসাম থেকে প্রতিনিধিত্ব করে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেছিলেন প্রয়াত শরৎচন্দ্র সিংহ। মন্ত্রিসভায়ও প্রতিনিধিত্ব করেছেন অনেকে।
আশির দশকে অর্থাৎ আসু-র বিদেশি খেদা আন্দোলন চোখ খুলে দেয় বোড়োদের। তাই আসু-র আন্দোলনের পরে পরেই স্বগোষ্ঠীয় লোকেদের একত্রিত করে সাংবিধানিক অধিকার আন্দোলনে নেমে পড়ে বোড়ো সম্প্রদায়ের অগ্রণী গণ-সংগঠনগুলি। এটা কিন্তু অনগ্রসর এলাকার উন্নয়নের জন্য নয়। এটা ছিল বোড়োদের স্বাধিকারের আন্দোলন। ১৯৮৬ সাল থেকে নিখিল বোড়ো ছাত্র সংস্থা ও সহযোগী বোড়ো জঙ্গীদের হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৯৩ সালে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে গঠন করা হয় বোড়ো অটোনমাস কাউন্সিল। কিছুদিনের মধ্যেই প্রমাণিত হল এই স্বশাসন অকেজো। ফের শুরু হল জঙ্গি আন্দোলন। চলল ২০০৩ সাল পর্যন্ত। আবার ত্রিপাক্ষিক চুক্তি। সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলের আওতায় গঠিত অধিক ক্ষমতার স্বশাসন। কয়েক বছরের মধ্যেই আওয়াজ ওঠে, এটি অবহেলিত বোড়োদের সামনের সারিতে তুলে আনতে সক্ষম নয়। তাই পৃথক বোড়ো রাজ্য চাই।
মনে রাখতে হবে, এই এতটা বছরে (অর্থাৎ ণ্ণঅধিক ক্ষমতার স্বশাসন’ থাকা সত্ত্বেও) বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ লাভ করার পরও অনগ্রসর এলাকার কোনো উন্নতি হয়নি। মুসলিম, রাজবংশী, সাঁওতাল, বাঙালি সহ অন্যান্য অ-বোড়োদের অবস্থা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। কারণ, স্বশাসিত বোড়োভূমিতে বোড়োরা যতটা সুবিধা ভোগ করেছে, অ-বোড়োরা তার এক আনাও পায়নি। রাজনৈতিক ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে ছিল বোড়োদের হাতে। একটা ছোটো উদাহরণ দিই। বাসুগাঁও পুরসভার চার ওয়ার্ডের বাসিন্দা-ভোটারের ৯৯ শতাংশই অ-বোড়ো সম্প্রদায়ের। একই অবস্থা কোকরাঝাড় পুরনিগমের। অথচ এই দুই পুর প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের পদ তফশিলি উপজাতিদের (বোড়োদের) জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে ইদানিং। এর ফলে সামান্য সুবিধে যেমন, বিপিএল কার্ড, বিধবা ভাতা ইত্যাদি সরকারি সুবিধা অ-বোড়োদের জন্য হলেও তারা ভোগ করতে পারে না। গ্রামে গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে ভিসিডিসি বা গ্রামীন উন্নয়ন পরিষদ। এখানেও স্বশাসনের ক্ষমতাসীনদের দাপট ও একচেটিয়া আধিপত্য। দু’বারের নির্বাচিত অ-বোড়ো প্রতিনিধিরা স্থান পায় না মন্ত্রীসভায়। অথচ বোড়োদের অহিংস আন্দোলনে সহায়তা করেছে প্রত্যেক অ-বোড়ো জনগোষ্ঠীর লোকেরা।
কয়েকবছর ধরে দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ বোড়ো বাসিন্দা রয়েছে, এরকম এলাকাকেও অত্যন্ত কৌশলে বোড়ো টেরিটরির (বিটিএডি) মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। পাঠশালা, বরমা, বাসুগাঁও, ফকিরাগ্রাম, সাপটাগ্রাম, গোসাইগাঁও ইত্যাদিতে শূন্য থেকে পাঁচ-দশ শতাংশ বোড়ো রয়েছে। অথচ এগুলি বিটিএডির অন্তর্গত। এইসব আর্থ-সামাজিক বিভেদ বৈষম্যের কারণেই অ-বোড়োদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের একটি বড়ো অংশ আমসু (নিখিল আসাম সংখ্যালঘু ছাত্র ইউনিয়ন) এবং বোড়োল্যান্ড আমসু-র ব্যানারে সম্প্রতি মুখর হয়ে ওঠে। এটাই সহ্য হয়নি ক্ষমতার বলে বলীয়ানদের। গোসাইগাঁও-এ দুই নিরপরাধ মুসলিম যুবককে হত্যা, শেরফাংগুড়িতে মুসলিম দিনমজুর হত্যার পর গত ১৮ জুলাই কোকরাঝাড়ে দুই প্রাক্তন আমসু নেতার ওপর হামলা এবং এর জেরে ১৯ জুলাই রাতে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে চার বন্দুকবাজ প্রাক্তন বোড়ো লিবারেশন টাইগার সদস্যের হত্যাকাণ্ড স্ফুলিঙ্গের কাজ করে দিল।