- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

সোয়াইন ফ্লু এবং আমাদের বেঁচে থাকা

সোয়াইন ফ্লু নতুনভাবে ফিরে এসেছে , ফটোঃhttp://www.thesilveredge.com/cs_swineflu.shtml
সোয়াইন ফ্লু নতুনভাবে ফিরে এসেছে , ফটোঃhttp://www.thesilveredge.com/cs_swineflu.shtml

অমিতাভ চক্রবর্ত্তী,কোচবিহার ,২৭শে ফেব্রুয়ারী,২০১৫,#
সম্প্রতি (১৯শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৫) পাড়ার একজন দাদা (গণেশদা) মারা গেলেন। দাদা মানে মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হতো। কখনো বা হাল্কা দু-চার কথা, কেমন আছেন, কোথায় যাচ্ছেন এই রকম আর কি। ৫২ বছর বয়স, ব্যঙ্ক কর্মী। প্রায় আট দশ দিন থেকে জ্বরে ভুগছিলেন। প্রথমে স্থানীয় ডাক্তার, কোচবিহারের নার্সিংহোম এবং শেষে শিলিগুড়িতে। দিন দুয়েক আই.সি.ইউতে থাকার পর মারা গেলেন। রোগের লক্ষণ দেখে ডাক্তারদের সন্দেহ মৃত্যুর কারন সোয়াইন ফ্লু। তবে শুধুই সন্দেহ। কারন উত্তরবঙ্গের জেলা শহরে এই রোগ নির্ণয়ের জন্য যথাযথ পরীক্ষা ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। আর রোগীর রক্ত বা লালা পাঠিয়ে কোলকাতা থেকে রিপোর্ট আসতে আসতে তো কমপক্ষে পনেরো কুড়ি দিনের ব্যাপার! ততদিন পর্যন্ত রোগী বেঁচে থাকলে তো চিকিৎসা!
আসলে কি এই সোয়াইন ফ্লু? সোয়াইন ফ্লু একধরনের ভাইরাস ঘটিত অসুখ যা শুয়োরের শ্বাসনালীতে সংক্রমণ ঘটায়। ফলে গলা ব্যাথা, নাক দিয়ে জল পড়া, কাশি, খাবারে অনিচ্ছা ইত্যাদি উপসর্গ হয়। আসলে মানুষের ফ্লু হলে যা যা উপসর্গ হয় ঠিক তাই। ১৯৩০ সালে মেক্সিকোতে শুয়োরের দেহে প্রথম এই ভাইরাস চিহ্নিত হয়। পরবর্তী প্রায় ৬০ বছর ধরে সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বলতে প্রায় সব ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র ইনফ্লুয়েঞ্জা(H1N1) ভাইরাস (ব্র্যকেটের সংকেত ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ধরণ প্রকাশ করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি)-কেই বোঝাত। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে একবিংশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত এই ভাইরাস স্ট্রেইন পরিবর্তন করে ইনফ্লুয়েঞ্জা(H3N2), ইনফ্লুয়েঞ্জা(H1N2) এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা(H4N6) এই তিনটি রূপে কানাডা সহ উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন জায়গার শুয়োরে পাওয়া গেল। প্রধানতঃ শুয়োরের দেহে থাকলেও ভিন্ন প্রজাতি-সংক্রমন বা cross-species infections (যেমন এক্ষেত্রে শুয়োর থেকে মানুষ বা মানুষ থেকে শুয়োর) -এর মাধ্যমে এই ভাইরাস স্ট্রেইন পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। এবার প্রশ্ন হল সাধারণতঃ স্থানীয় শুয়োরের দেহে থাকলেও মানুষ-শুয়োর বা শুয়োর-মানুষ এই ভিন্ন প্রজাতি-সংক্রমন হয় কেন? প্রথমতঃ ইনফ্লুয়েঞ্জা পরিবারের সব ভাইরাস (টাইপ-A, টাইপ-B এবং টাইপ-C) হল RNA ঘটিত ভাইরাস যাতে segmented genome থাকে অর্থাৎ এই ভাইরাসে জেনেটিক কোড হিসাবে কেবলমাত্র RNA-র একটি তন্ত্র (Strand) নয়, বরং আটটি আলাদা RNA-র অংশ (Segment) থাকে। এবার কোন মানব দেহের (বা পাখির) ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস শুয়োরের শ্বাসনালীতে সংক্রমণ ঘটালে হয়ত ভুলক্রমে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের এক বা একাধিক RNA-র প্রতিলিপি সোয়াইন ফ্লু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে প্রবেশ করে নতুন এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের (new subtype) জন্ম দিল যা কিনা প্রাধানতঃ মানুষের দেহেই সংক্রমণ ঘটায় যদিও তাতে সোয়াইন ফ্লু-র বৈশিষ্ট পুরোপুরি বজায় থাকে। দ্বিতীয়তঃ শুয়োরের দেহকে মিশ্রন পাত্রের (mixing pot) মতো ব্যবহার করেও নতুন ধরনের ভাইরাসের সৃষ্টি হতে পারে। শুয়োরের শ্বাসনালীর কোষ সহজে আক্রান্ত হয় বলে পাখি, মানুষ বা অন্য কোন স্তন্যপায়ীর সাধারন ফ্লু ভাইরাস এখানে সোয়াইন ফ্লু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সাথে RNA-র অংশ বিনিময়ের মাধ্যমে তৈরী করতে পারে নতুন ধরনের ফ্লু ভাইরাসের। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এই ঘটনা দুটিকে যথাক্রমে Antigen Shift এবং Antigen Drift বলে।

অর্থাৎ একই প্রজাতীর ভাইরাসের সহজেই স্ট্রেইন পরিবর্তন করে নতুন নতুন রূপে নতুন নতুন উপসর্গ নিয়ে হাজির হওয়াতেই এত বিপত্তি। এতে একদিকে যেমন কেবলমাত্র উপসর্গ দেখে ডাক্তারবাবু সঠিক রোগ ধরতে সমস্যায় পড়েন তেমনি ধন্ধে থাকেন সঠিক ওষুধ নির্বাচনে। ভরসা বলতে রোগীর দেহের নিজস্ব অনাক্রম্যতা যা দেহে ভাইরাসের উন্মেষ পর্বের (Incubation Period) ধকল নিতে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে।। রোগের উপসর্গ হিসাবে কারো ক্ষেত্রে খুব জ্বর, মাথা-গলা ও শরীরের অন্যান্য জায়গায় ব্যথা, নাক দিয়ে জল পরা আবার কারো ক্ষেত্রে বা এসবের সাথে ডায়রিয়া, বমি ও শ্বাসকষ্ট। প্রাথমিক সংক্রমনের তিন থেকে চার দিনের মধ্যেই সাধারনতঃ এই শারীরিক সমস্যাগুলি প্রকট হতে থাকে। বেশী দিন সংক্রমন থাকলে শারীরিক দুর্বলতা জনিত কারনে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবির দ্বিতীয় সংক্রমনে (Secondary infection) মৃত্যুও হতে পারে। এমনকি উন্নত দেশগুলিতেও প্রতি বছর সাধারন ফ্লু-তে যতজনের মৃত্যু হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা(H1N1) এর সংক্রমনে তার প্রায় ৩ গুন বেশী লোক মারা যায়। তবে এই মৃত্যুর হার অবশ্য শিশু এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রেই বেশী।

কেন্দ্রিয় স্বাস্থ মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ি এই ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ অবধি ইনফ্লুয়েঞ্জা(H1N1)-এর সংক্রমণে পুরো দেশে ৯৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর আক্রান্তের সংখা প্রায় ১৭০০০। রাজস্থান, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মির, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, নাগাল্যন্ড সহ আরও কয়েকটি রাজ্যকে এই রোগের মোকাবিলায় সতর্কতা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে। সরকারি হিসাবে আমাদের রাজ্যের অবস্থা খুব বেশি উদ্বেগ জনক না হলেও দুশ্চিন্তা একটা থেকেই যায়। তাছাড়া আমাদের মতো দেশে যেখানে সরকারি তথ্য ও প্রকৃত বাস্তবের মধ্যে অনেক ফারাক!

তাহলে উপায়?
এই ভাইরাসের সংক্রমণের কারণ জানলে তা থেকে রক্ষা পাওয়া উপায় ভাবা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে তিনপ্রকারে এই সংক্রামণ হতে পারে। এক তো ‘শুয়োর থেকে মানুষ’, এই প্রত্যক্ষ সংক্রমনের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানো। যদিও মনে করা হয় খামারে শুয়োরের সরাসরি পরিচর্যার সময় এই সংক্রমণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। বিশেষ করে কাজের সময় চোখ, নাক, মুখ দিয়ে এই ভাইরাস দেহে প্রবেশ করতে পারে। তবে ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ায় বলে খামার সংলগ্ন মানুষও এইভাবে সংক্রামিত হতে পারেন। তাই সংক্রমণের বাড়াবাড়ির সময় (epidemic session) এই অবস্থা থেকে বাঁচতে যথা সম্ভব শুয়োরের সংস্রব এড়িয়ে চলা ও নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি শুয়োরের সরাসরি পরিচর্যার সময় বিশেষ পোশাক ব্যবহার করে সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখা দরকার। আর ‘মানুষ থেকে মানুষে’ এই সংক্রমন হয় সাধারণতঃ হাঁচি, কাশি, কফ-থুতু ছাড়াও আক্রান্ত মানুষের ব্যবহৃত জিনিসপত্র যেমন খাতা-বই, মোবাইল, কলম প্রভৃতির মাধ্যমে। এমনকি একসাথে আহার বা হ্যন্ডসেক করাও এই সময় নিরাপদ নয়। তাছাড়া আছে টিকাকরণ। উন্নত দেশগুলিতে বিভিন্ন প্রকার ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকাকরণের ব্যবস্থা আছে।

তবে কেবলমাত্র টিকাকরণের মাধ্যমে নিত্যনুতন রূপে আবির্ভূত এই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসকে ঠেকানো যাবে বলে মনে হয় না। আসলে Antigen Shift এবং Antigen Drift-এর মাধ্যমে ভাইরাসের স্ট্রেইন পরিবর্তন কিন্তু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। তাই সামাজিক জীব হিসাবে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে আমাদের কাছে একমাত্র উপায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ও দৈহিক অনাক্রাম্যতা বাড়িয়ে তোলা। তবে এই অনাক্রম্যতা বাড়ানো তো আর কেবল ওষুধ খেয়ে হবে না! এর জন্য চাই মরসুমি ফলের রস ও শাকসব্জি গ্রহণ। কৃত্তিমতা বর্জনকারী দেশজ খাবার পুষ্টির চাহিদার পাশাপাশি দেহে প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে তোলে। এইসব খাবারে উপস্থিত এক বা একাধিক পদার্থের অ্যান্টি- অক্সিডেন্ট ধর্ম দেহের স্বাভাবিক জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া বিঘ্নকারি মুক্ত মূলক (Free radical)-এর বিনাশ ঘটায় এবং দেহকোষগুলিকে সজীব রাখে। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা না বললেই নয় যে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী সভ্যতা, নগরায়ন এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা যত উন্নতির শিখরের দিকে এগোচ্ছি ততই পাল্টে যাচ্ছে আমাদের জীবনচর্চা ও খাদ্যাভ্যাস। দোকান থেকে কিনে আনা প্রক্রিয়াজাত সুদৃশ্য খাবারকেই আমরা প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় প্রাধান্য দিচ্ছি। অবহেলায় ত্যাগ করছি পূর্বসূরীদের খাদ্য প্রস্তুতির প্রাচীন ঐতিহ্যকে যা হাজার হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল বিভিন্ন জৈবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে। নোবেলজয়ী চিকিৎসক বিজ্ঞানী লুই মোঁতাইনিয়ে ২০০২ সালের জুন মাসে পোপ দ্বিতীয় জন পলের বার্ধক্য জনিত রোগের চিকিৎসায় গ্যাঁজানো পেপের রস থেকে তৈরি একধরণের পদার্থ ব্যবহার করে সুফল পেয়েছিলেন। বিজ্ঞানীর মতে ওই বিশেষ পদার্থটির খুব ভাল অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ধর্ম রয়েছে। অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনে কেবলমাত্র গুটিকয় অ্যান্টিবায়টিকের উপর নির্ভর করে না থেকে খাদ্যাভ্যাসে নিজস্ব ঐতিহ্যের মিশেলও জরুরী। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র তবেই রোগ প্রতিরোধ ও রোগ নিরাময়ে সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে।