- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

সুলেমানপুরের গানবাজনার আখড়ার কথা

৪ জুন, উজ্জ্বল মণ্ডল, সুলেমানপুর, কোপাই, বীরভূম#

ছবি তুলেছেন জিতেন নন্দী।
ছবি তুলেছেন জিতেন নন্দী।

১৯৮৫ সালে আমার জন্ম। আমি সবজি, মাছ আর ধান চাষ করি। পুকুর নিজেদের কিছু আছে, কিছু লিজে নিয়ে মাছ চাষ করি। এই তো এখনই পুকুরে খোল ছিটিয়ে এলাম। ডিম পোনা করে বিক্রি করি, বড়ো মাছও বিক্রি করি। জমি আছে অল্পসল্প। সবজি আর ধান যা হয় নিজেদের চলে যায়। সবজি কিছু বিক্রিও করি — লঙ্কা, বেগুন, টমাটো, কপি। কোনোমতে চলে যায়।
আমার এক দিদি বন্দনা কীর্তন করত। ওর বাবা নারায়ণ মণ্ডল কীর্তনের মূল গায়েন ছিল। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর ঝোঁক পড়ে গেল। দু-তিনমাস ছুটি থাকে। ভাবলাম, তাহলে গান শিখি। দিদির কাছে গিয়ে টুকটাক হারমোনিয়াম বাজাই। দিদি দেখিয়ে দিত। ক্ষুদিরাম লোহার ওখানে আসত। তাকে ধরলাম, আমাকে গান শিখিয়ে দিতে হবে। উনি বললেন, ‘দ্যাখ যদি শিখতে পারিস।’ আমি বললাম, ‘না, শিখিয়ে দিতে হবে।’ তখন ১৪০৩ সাল। আস্তে আস্তে শিখতে থাকলাম। কিছু হরিনামের পদ শিখিয়ে দিল। সেগুলো মুখস্থ করি আর শিখি। সন্ধ্যা আরতি, ভোগ আরতি, মোহান্ত বিদায় — যেগুলো আমাদের গৌরীয় মণ্ডলে লাগে, সেগুলো শিখলাম। আরও কিছুটা উন্নতি হল। তারপর ক্যাসিও কিনলাম, কীর্তনের মূল গায়েনের সঙ্গে যেতে লাগলাম। গোরাচাঁদ বলে একজন আছে আলবাঁধায় উনি ছিলেন মূল গায়েন, ওর সঙ্গে যেতাম। সর্বমঙ্গলার ডাঙার আশ্রমের যে বাবাজি, তার ভাই উনি। আরও অনেকের সঙ্গে গেছি। দোহার করতাম আর ওটা বাজাতাম। বিয়ের আগে পর্যন্ত বছর চার-পাঁচ এইভাবে ঘুরেছি। এদিকে ব্যান্ডেল, ওদিকে মুর্শিদাবাদ, অনেক জায়গায় গেছি।
ইদানীং হরিনামের ধুলোট করছি। হরিনাম যেদিন শেষ হবে, সেদিন বিভিন্ন দল এসে গোটা গ্রাম ঘুরবে। প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি যাবে। যেমন, সিউরে আজ থেকে শুরু হবে, চারদিন চলবে। শেষেরদিন ধুলোট হবে। আমাদের গাবুর একটা দল আছে, আর একটা খোলের দল। খোলের দল কীর্তনের পদ-টদ গায়, তারা গাবুর বাউল গায় না। সকালের দিকে হলে সাজান-গোষ্ঠ গাওয়া হবে, কৃষ্ণ গরু চরাতে যাবে সেইসব পদ। দুপুরের দিকে হলে শুভন-মিলন হবে, গোষ্ঠে গিয়ে খেলা করবে। বিকেলের দিকে হলে ফেরত-গোষ্ঠ হবে, গরুর পাল নিয়ে ফিরে আসছে। আর আছে বিকেলের দিকে রূপ-পালা, রাধারানি যমুনাতে জল আনতে গিয়েছে, সখীদের বলছে, ‘আমি কী রূপ হেরিলাম মধুর মুরতি …’। রাতের আগে হয় পূর্বরাগ, ওটা আমরা গাই না।
আমাদের গ্রামে তিনবছর গৌরমণ্ডল হল। সেখানে সাধুবাবার মারফতে নদিয়া থেকে বাউলের একটা দল এসেছিল। সেই শুনে আমাদের বাউলের নেশা চেপে গেল। মূল গায়েন যে ছিল তার সঙ্গে খুব পরিচয় হয়ে গেল। বললেম যে শিখব। সাধুবাবা বাউল জানে, একটা গাবু দিলে। তখন বাউলের ঝোঁক পড়ে গেল। বাউল হল কাঁচাতত্ত্ব, দেহের তত্ত্ব — আমাদের দেহের ভাণ্ডে যা আছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে। দেহের মধ্যে … খুলে খুলে এক-একটা পদ লিখে দিলে। বাউল গাইছি এই দু থেকে তিন বছর। বোলপুরের পাশে কঙ্কালীতলার বাসু ঘোষের কাছ থেকে কিছু কালেকশন করেছি। কঙ্কালীতলার ওপর একটা গান আমাদের ক্ষুদিরাম লোহার লিখেছে। বাহান্ন পীঠের মধ্যে কঙ্কালীতলা একটা পীঠ, দেবীর কঙ্কালটা ওখানে পড়েছিল। চৈত মাসের সংক্রান্তির দিনে ওখানে মেলা হয়। ওখানে প্রচুর বাউল।
আমাদের দলে দোতারা বাজায় আনন্দ হাজরা। ভোলা ডোম অনেক গান জানে। ও পড়তে জানে না, শুনে শুনে মনে রাখে। ‘কে আনিল রে, কোথায় ছিল রে, মধুমাখা হরিনাম’ গানটা এখানে খুবই জনপ্রিয়, লিখেছে বিজয় ধীবর। আমাদের যখন হরিনাম হয়, সবাই মিলে এই গানটা গায়। শ্রোতারা এই গানটা শুনতে চায়।