- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

সাগরদ্বীপে একদিন — জৈব চাষের খোঁজে

১৬ এপ্রিল, অমিতা নন্দী, মহেশতলা রবীন্দ্রনগর#
১২ এপ্রিল রবিবার সকাল ৬টা ২০ নাগাদ আমরা সদলবলে রওনা হলাম সাগরদ্বীপের উদ্দেশ্যে, একটি ভাড়া সুমোগাড়িতে চেপে। আমরা দলে ছিলাম সাতজন — আমি, জিতেন, নেপালের চিতওয়ান জেলার জৈব চাষি চন্দ্রপ্রসাদ অধিকারী, আমেরিকার উইসকনসিন থেকে আসা দম্পতি স্টিফেন মাইকসেল (স্টিভ) এবং যমুনা, কাঠমাণ্ডু থেকে আসা দম্পতি কেশব ও অনিতা। শেষোক্ত দুইজন অ্যাকশন এইড নামক সংস্থার হয়ে নানা দেশে চাকরি করে অবশেষে সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নেপালে জৈব চাষের কাজে যুক্ত হতে ব্রতী হয়েছেন। তাই অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য এঁরা ভারতবর্ষের কিছু জায়গায় ঘুরছেন যেখানে যেখানে জৈব চাষ ও প্রাকৃতিক চাষের কাজ চলছে। কাকদ্বীপের ৮নং ফেরিঘাট থেকে আমাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে যোগ দিলেন ‘নিউজ’ (NEWS) সংস্থার কর্মী উমাপতি সরকার মহাশয়।
প্রায় ৪০ মিনিট লঞ্চে পার হয়ে বার ধরে প্রথমে আমাদের তিনি নিয়ে গেলেন গঙ্গাসাগরের কপিল মুনির আশ্রমে। ফেরার পথে অনেকটা বেলা হয়ে গেছে দেখে, যে গ্রামে আমাদের মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। বাস রাস্তা থেকে সামান্য পথ, যেতে যেতে শুনলাম এখানে কয়েকটা গ্রামে বছরখানেক হল কিছু কিছু চাষি জৈব পদ্ধতিতে চাষবাস করছেন। পথে একটা পুকুরের চারপাশে নেট লাগানো দেখলাম। শুনলাম ওখানকার জল পরিষ্কার করে অন্য বড়ো পুকুর থেকে জল ভরা হয়েছে, মাছের ছোটো ছোটো পোনা ফেলা হয়েছে — সাপ-ব্যাঙ বা অন্য উপদ্রবের হাট থেকে বাঁচিয়ে মাছ চাষের জন্য এই নেট দিয়ে ঘেরার ব্যবস্থা। তারপরেই এক গৃহস্থের বাড়ির আঙিনা। তিনজন বধূ সেখানে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে — দুজনের হাতে পূজার থালা, শেষজনের হাতে একটা শঙ্খ। ভাবছি কোনো ব্রত বা পূজার আয়োজন। ইতস্তত করছি দেখে উমাপতিবাবু বললেন, চলুন চলুন, থামবেন না। উঠোনে পা দিতেই বেজে উঠল শঙ্খ, প্রথম বধূটি এগিয়ে এসে সবার হাতে একটি করে ফুলের তোড়া (লাল জবা, কমলা জবা, নতুন ধানের ছড়া, টগর ফুল ও তার পাতা দিয়ে সযত্নে বানানো) এবং দ্বিতীয়জন সবার কপালে এক এক করে সাদা চন্দনের টিপ পরিয়ে দিলেন। এহেন আবাহনে অভিভুত হয়ে গেলাম সবাই।
মাটির দাওয়ায় বসে সবাই লেবুর শরবত খেলাম আর খোলা ঠান্ডা হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে গেল। মাথার ওপর খড়ের চাল, খোলামেলা মাটির বাড়ি। বারান্দায় মেঝেতে অনেক আলু রাখা, ঘরে দেখি সিলিঙের কিছু নিচে বাঁশের গায়ে দড়ি টাঙিয়ে সুন্দর ভাবে গুচ্ছ-গুচ্ছ পেঁয়াজ ঝুলছে। যে তিনজন মহিলা আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তাঁদের প্রথমজন সুষমা এই পরিবারের বধূ, বাকিজন প্রতিবেশী-আত্মীয়া।
সুষমা হলেন একজন খাঁটি চাষি। ওদের এক বিঘা জমি। ওঁর স্বামী প্রাথমিক স্কুলের পার্ট-টাইম শিক্ষক, হার্টের অসুখ আছে। ফলে চাষের যাবতীয় কাজের সিংহভাগ করেন সুষমা, খুবই মনোযোগের সঙ্গে। ‘নিউজ’ (NEWS) সংস্থা থেকে এখানে বিভিন্ন চাষিকে মাঝে মাঝে ক্লাস নেওয়া হয় — জৈব চাষ সম্পর্কে উৎসাহিত করার জন্য। যাদের মধ্যে সেরকম জেদ থাকে, নতুন কিছু করার সাহস থাকে, তারাই নিজেদের থেকে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে শুরু করে। কৃষ্ণনগর গ্রামের তেমন কিছু উদ্যোগী চাষির একজন এই সুষমা।
দুপুরে তিনি আমাদের যা কিছু খাওয়ালেন সেইসব ওঁর নিজের জৈব চাষের ফসল। এক কাঠিতে বোনা ‘দুধের সর’ চালের ভাত, ডাল, নিম-ফুল ভাজা, ঝিঙে আলু পোস্ত, নিজেদের পুকুরের মাছ আর কাঁচা আমের টক। আমাদের বিদেশি সঙ্গীরা দুবার করে ভাত চেয়ে নিয়ে তৃপ্তি করে সব খেলেন। যমুনাদির ওই নিমফুল ভাজা এত ভালো লেগে গেল যে আমরা ওখান থেকে বেশ কিছুটা নিম ফুল ও পাতা নিয়ে এসে রোদে শুকিয়ে আর একদিন ভেজে ওদের খাওয়ালাম, আর কিছুটা উনি নিয়ে গেলেন আমেরিকায় কোনো বন্ধুকে দেবেন বলে।
খাওয়ার পর আমরা একসাথে বসে যখন কথাবার্তা চালাচ্ছি সুষমা ওঁর খাতা নিয়ে এলেন। সুন্দর হস্তাক্ষরে অনেকটা সায়েন্সের প্র্যাক্টিকাল খাতার মতো সব বিবরণ লিখে রাখছেন। ক্লাসে কী শিখলেন আর নিজের খেতে প্রয়োগ করতে গিয়ে কবে বীজ রোপণ করলেন, কীভাবে করলেন, কী ফল পেলেন সবকিছু তারিখ অনুসারে লেখা। প্রশ্ন করে জানলাম, সুষমা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন। বয়সও বেশ কম। বেশ বুদ্ধিমতী, একরোখা গোছের। ওদের কাছে শুনলাম মিরাক্‌ল মিক্সচার তৈরি করার পদ্ধতি। গোবর, গোমূত্র, চিটে গুড় (মোলাসেস) আর জল বিশেষ মাত্রায় মিশিয়ে মাঝে মাঝে তাকে নাড়িয়ে (বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি হয় এই মিশ্রণ। তারপর প্রয়োজন মতো তার ঘনত্ব কমিয়ে বা বাড়িয়ে খেতে প্রয়োগ করা হয়, কখনো গাছকে তাজা করার জন্য, কখনো পোকার উপদ্রব কমাতে।
মনে পড়ে গেল, গুজরাতের ভালসার জেলার ভাস্কর সাভের জৈব চাষের ফার্ম ‘কল্পবৃক্ষ’-তে যখন গত নভেম্বর মাসে একটা ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিতে গিয়েছিলাম, সেখানে এমন অনেক কিছু শুনেছিলাম। নিজেরা এধরনের কোনো প্রয়োগে যুক্ত হতে পারিনি বলে সবটা অনুধাবন করা মুশকিল।
ওদের জৈব চাষে যে আলু-পেঁয়াজ ফলে তা ঘরেই খোলা জায়গায় একবছর অবধি রাখা যায়। বর্ষায়ও তা নষ্ট হয় না। নিজেদের সারা বছরের খোরাক নিজেরাই তৈরি করতে পারেন, কোনো বাড়তি লেবার খরচ নেই। এককাঠির চাষ মানে বীজতলা থেকে দশ-পনেরোটা করে চারাগাছ নিয়ে একএক জায়গায় রোপণ করার বদলে নির্দিষ্ট দূরত্বে একটি করে চারা রোপণ করা। ফলে বীজের খরচ কমে যায়। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কিনতে হয় না — ফলে উৎপন্ন ফসল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে নিজেদের শরীরে বিষ যায় না, স্বাস্থ্যের পক্ষে তা ভালো। চলে আসার আগে সুষমার খেত এবং কমপোস্ট সার তৈরির পদ্ধতি আমরা স্বচক্ষে দেখে এলাম। তারপর আবার কিছুটা বাসপথে গিয়ে দ্বিতীয় এক চাষি পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হলাম।
সুনন্দিতা এবং তাঁর স্বামী। বাস রাস্তার ওপর একটা বাঁশ এবং দরমা বিক্রির দোকান আছে ওঁর স্বামীর। এছাড়া সামনে ১৭ কাঠা ধানের জমিতে যেন সবুজের ঢল নেমেছে। কয়েকটা পুকুর — ছোটোবড়ো, সবজি খেত, ধানের গোলা, হাঁসমুরগির আস্তানা আর গরুর গোয়াল। ওঁদের দুটি মেয়ে, একটি ছেলে — সবাই পড়াশোনা করে। সুষমার বাড়িতেও দেখেছি নিজেদের দেশি গরু আর মুরগির প্রতিপালন হয়। সেই গরুর মূত্র এবং গোবর চাষের কাজেও লাগছে। সুনন্দিতা বললেন যে ওঁর বাড়িতে নাকি আমাদের সকালে জলযোগ করার কথা ছিল। তাই লুচি ভেজেছেন এবং ঘরেই মিষ্টি তৈরি করেছেন। পেট পুরে ভাত খেয়ে আসায় সবাই শুধু মিষ্টি খেল — নারকেল, সুজি, ময়দা আর চিনি দিয়ে তৈরি অপূর্ব সেই জিনিস।
কপিল মুনির আশ্রম দেখতে গিয়ে এত সময় চলে গেছে যে আমাদের আরও যে কয়েকটি গন্তব্যস্থান ছিল সব জায়গায় যাওয়া হল না। তবে পথেই দেখা হল আর একজন উদ্যমী চাষি ইন্দিরার সঙ্গে। উনি রাস্তায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শুনেছি ওঁর ওখানে আরও কিছু জিনিস দেখা ও জানা যেত। সময়াভাবে এযাত্রা আর তা হল না। এই আক্ষেপ নিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম।