- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘সাইকেলেই জড়িয়ে ছিল তাঁর জীবন’

রঘু জানা, পর্ণশ্রী, ২৪ নভেম্বর#

বাসের ধাক্কায় নিহত বিশ্বনাথ বিশ্বাস (৪৮)
বাসের ধাক্কায় নিহত বিশ্বনাথ বিশ্বাস (৪৮)

ব্রেসব্রিজের জিঞ্জিরা বাজার থেকে উপেন ব্যানার্জি রোড ধরে গিয়ে পর্ণশ্রীতে বিবেকানন্দ কলোনি। ১৩ নম্বর বাসের রাস্তা ছেড়ে বিবেকানন্দ সঙ্ঘের গা ঘেঁষে ছ-ফুটের গলি। গত সপ্তাহে (১৯ নভেম্বর) বাস দুর্ঘটনায় নিহত সাইকেল চালক বিশ্বনাথ বিশ্বাসের বাড়ি এখানেই।
রবিবারের বেলা এগারোটা। চাপা নিস্তব্ধতার মাঝে মিনিট খানিক অন্তর একটা শালিকের ডাক। কচুরিপানা ভর্তি পুকুরের লাগোয়া কর্পোরেশনের জলের কলে দুজন মহিলা বসে বাসন ধুচ্ছিলেন। তার একটি বাড়ির আগেই দোতলা বাড়ি, ওপরের অংশে সিমেন্টের পলেস্তারা পড়েনি। লোহার তারের গেট খুলে এলাকার মানুষ বিজনদা ঢুকলেন, সাথে আমি ও শমীক। আমাদের আসার কারণ জানাতে বছর পঁচিশেকের এক যুবক একটি ঘরে আমাদের বসতে বললেন। দিনের বেলা একটা টিউব জ্বেলে বছর বারো তেরোর একটি ছেলে বই নিয়ে খাটে বসে পড়ছিল। আমরা ঢোকাতে সে বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে খাটে বসেছিল আমাদের সামনে। মাথা সদ্য কামানো। গোলগাল মায়া মাখা মুখখানা। নিহত বিশ্বনাথ বিশ্বাসের একমাত্র ছেলে রাজদীপ বিশ্বাস (রনি)। ক্লাস সিক্সে পড়ে।
কথা বললেন নিহত বিশ্বনাথের ভাগনা শশাঙ্ক দাস। তাঁর মামা বিশ্বনাথই তাঁকে এখানে এনে রেখে পড়াশোনা শিখিয়ে বড়ো করেছেন। তাঁর জবানিতে জানলাম, আট দশ বছর আগে তিনি তারাতলা মোড়ে ডিটিডিসি কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসে কাজ করতেন। অস্থায়ী কর্মী ছিলেন। তিন চার বছর কাজ করেছিলেন। ওখান থেকে লেক কালীবাড়ির কাছে একটা কুরিয়ার সার্ভিস অফিসে (ব্লেসফ্ল্যাশ) কাজ করতেন। ওখান থেকে চিঠি পার্সেল সব সংগ্রহ করে, আবার এখানে আসতেন। সরশুনা বকুলতলা মোল্লার গেট পর্ণশ্রী রবীন্দ্রনগর — সেই চিঠিগুলি বিলি করতেন। থেকে যাওয়া চিঠি বা পার্সেলগুলি আবার অফিসে ফেরত দিতে হত। চিঠিপত্রের হিসেব মিটিয়ে সন্ধ্যের সময় বাড়ি ফিরতে হত তাঁকে। চার বছর এই কাজটি করেছিলেন। তারপর আর কাজটা করতে পারছিলেন না। বয়সও হচ্ছিল। প্রায় আটচল্লিশ বছর বয়স। তারপর কিছুদিন ঘরে বসেছিলেন। যদিও মাঝে মাঝে অন্যের কাজ করে দিচ্ছিলেন পয়সার বিনিময়ে। উনি ঘরে বসার লোক ছিলেন না।
এরপর ওঁর জন্য একটা ভালো কাজ দেখা হয়। নিউ আলিপুরের ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের কাছে একটা গাড়ির শো-রুমে কাজ জোটে। ওখানে মূলত বসে কাজ ছিল। কাজটা জয়েন করার পর উনি সাইকেলেই যাতায়াত করতেন। এত দূর দূর সাইকেল চালিয়ে একসময় চিঠি বিলি করেছেন, তাই বর্তমান কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। বাসভাড়াটাও বাঁচত। এই কাজটি করার আগে কিছুদিন ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তিনমাস হল স্থায়ী কর্মী রূপে কাজে যোগ দিয়েছিলেন।
ঘটনাটি ঘটেছিল সকাল পৌনে দশটা নাগাদ। সাড়ে নটার সময় উনি ভাত খেয়ে অফিস রওনা হতেন। সকাল দশটা নাগাদ ওঁকে কাজে ঢুকতে হত। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পর্ণশ্রী বিবেকানন্দ পার্ক পেরিয়ে স্টেট ট্র্যান্সপোর্ট গ্যারেজটা ছেড়ে তারাতলার রাস্তায় পড়েছে। ওইটার পাশেই মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সেই সময় দুটো বাস রেষারেষি করতে করতে বজবজ থেকে আসা এসডি ৩০ বাসটি ওঁকে পিষে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। বাড়িতে স্ত্রী ও মা, ক্লাস সিক্সে পড়া ছেলে।
খুব মিশুকে মানুষ ছিলেন বিশ্বনাথ। মৃত্যুর খবর শুনে বাজারের ফুলওয়ালা বাড়ি ছুটে এসেছে। কাজের দিন ফুলে সাজিয়ে গেছেন। কিন্তু বিনিময়ে কোনো পয়সা নেননি। কেন না, বিশুদার মতো মানুষ হয় না। সব কাজ উনি সাইকেল চেপেই করতেন। সাইকেলেই জড়িয়ে ছিল তাঁর জীবন।
এক বিবাহিতা মহিলা আমাদের কথায় যোগ দিলেন, বললেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর উনিই ছিলেন পরিবারের মাথা। পরিবারকে আগলে রেখেছিলেন। ভালো মন্দ সিদ্ধান্ত ওঁকেই নিতে হত। ছেলে ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোল, আর রাতে ফিরল না। এ জিনিস তো আর দেখা যায় না।’
কথার মাঝে বিধবা মা এসে বসলেন, মুখে একটা করুণ ছাপ, কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ‘আর যেন কারোর ছেলে মায়ের বুক খালি করে চলে না যায়। ওর বাবা মারা গেছে পাঁচ বছর হল। ওকেই সব দিক …’ কথা শেষ করতে পারলেন না।
ফিরে আসার সময় গলির মুখে কর্পোরেশনের জলের কলে আঁচলা ভরে জল খেলাম। চুপচাপ ফিরছি, খেয়াল হলো শালিকটা আর ডাকছে না।