- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘সরকার কী করে কয়লা ব্লক নিলাম করে, খনিজ সম্পদের মালিকানা কি রাষ্ট্রের?’

সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, আসানসোল, ২৯ মার্চ#
মিথিলেশ কুমার ডাঙ্গে এসেছিলেন ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ জেলা থেকে। ‘আজাদি বাঁচাও আন্দোলন’-এর এই নেতা বললেন, সরকার যে কয়লা ব্লক নিলাম করছে — সরকার কি এই কয়লা ব্লকগুলির মালিক? সুপ্রিম কোর্ট ৮ জুলাই ২০১৩ সালের একটি রায়-এ জানায়, রাষ্ট্র নয়, জমির নিচের খনিজ সম্পদের মালিক ওই জমির মালিকানা যার, তারই। অন্তত ‘মাইনিং এন্ড মিনারেলস ডেভেলপমেন্ট রেগুলেশন আইন’-এ এর থেকে আলাদা কিছু বলা নেই। কেরালার একজন জমির মালিক কে পি বালাকৃষ্ণন নায়ার নিজের জমির নিচে গ্রাফাইট খনন শুরু করেছিলেন। কেরালা সরকার সেই খননে বাধা দেয়নি, শুধু ২০১৩ সালের জুন মাসে একটি নির্দেশ জারি করে বালাকৃষ্ণনের কাছ থেকে চোদ্দ লাখ টাকা চেয়েছিল, রয়ালটি বাবদ। সম্প্রতি ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে বালাকৃষ্ণন সুপ্রিম কোর্টে হাজির হয়েছেন এই দাবি নিয়ে যে সরকার তাঁর কাছ থেকে রয়ালটি চাইতেই পারে না। কারণ সুপ্রিম কোর্ট তো বলেই দিয়েছে, জমির নিচের খনিজের মালিক সরকার বা রাষ্ট্র নয়, জমির মালিক। অর্থাৎ সরকার যদি খনন করে, তাহলে রয়ালটি বরং পাওয়া উচিত জমির মালিকের।
মিথিলেশ বললেন, হাজারিবাগে বেশ কয়েকটি কয়লা ব্লক নিলাম করার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু তারা তো মালিক নয়, তাহলে তারা নিলাম করার কে? মিথিলেশরা একটি পরিকল্পনা করেছেন। হাজারিবাগের একটি কয়লা ব্লক নিলাম করছে সেখানকার গ্রামসভা — যা ওই কয়লা ব্লকের ওপরের জমির মালিকদের নিয়ে তৈরি। তারা ৩১ মার্চ ওই কয়লা ব্লকের নিলাম ঘোষণা করবে এবং যারা তা কিনতে চায় তাদের দর দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাবে। আসানসোলের সভামঞ্চ থেকে মিথিলেশ সেখানে উপস্থিত সবাইকে আহ্বান জানালেন, আসুন ৩১ মার্চ হাজারিবাগে।
আমাদের জীবন জীবিকার স্বার্থে আর কত কয়লা খনি দরকার? দূষণ সৃষ্টিকারী খোলামুখ কয়লাখনি কি এক্ষুণি বন্ধ করে দেওয়া উচিত নয়? জমির ওপরের মালিকানা যার, নিচের মালিকানাও কি তার নয়? প্রয়াত হারাধন রায়ের করা কেস-এর ওপর দাঁড়িয়ে সুপ্রিম কোর্ট আসানসোল রাণিগঞ্জ খনি অঞ্চলের ধ্বস আগুন প্রবণ এলাকা থেকে পুনর্বাসনের যে নির্দেশ দিয়েছিল, তার বাস্তব রূপায়ণ হয়েছে কি? — এই চারটি বিষয়ের ওপর আলোচনার করতে বেশ কিছু মানুষ হাজির হয়েছিলেন আসানসোল কোর্ট-এর হলঘর-এ। এই আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন ‘আসানসোল সিভিল রাইটস’ আন্দোলনের সাথী ঘোষ।
আলোচনার প্রথম দিকে বিভিন্ন খোলামুখ খনির দূষণ বিষয়ে আলোচনা করেন খোলামুখ খনিগুলির আশেপাশের এলাকার বাসিন্দারা। গঙ্গারামচক খোলামুখ খনি (এমটা) এলাকার কৃষি কল্যাণ সমিতির সমর বেরা, গোপীনাথ মণ্ডল জানান, তারা একশ’ ষাট জন কৃষক মোট ৪৩ একর জমি দিয়েছিলেন, কিন্তু ক্ষতিপূরণ পাননি। ক্ষতিপূরণ পেয়েছে অনাবাসী জমি মালিকরা, একর প্রতি সাড়ে চার লাখ-সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা করে।
সোদপুর খনির নিরাপত্তাকর্মী জানালেন, তার এলাকায় ২০০৩ সালে খোলামুখ খনি খোলা হয়। তার আগে এলাকায় ছোটোদের মধ্যে পড়াশুনার চল ছিল। কিন্তু খোলামুখ খনি চালু হবার ছোটোরা লেখাপড়া ছেড়ে খোলামুখ খনি থেকে কয়লা চুরির কাজে নেমে পড়েছে। ৭০-৮০ ফুট গভীরতার এই খোলামুখ খনিতে জল জমে যায়। একবার এক মাঝির ছেলে কয়লা চুরি করতে ঢুকেছিল, সিআইএসেফ তাকে তাড়া করে, সে জলে পড়ে যায়। তারপর এলাকার লোকের চাপে সেই খোলামুখ খনি বন্ধ হয়ে যায় বটে। কিন্তু সেই খোলামুখ খনির আশেপাশেই বেআইনি খাদান চলছে। বন্ধ করে দেওয়ার সময় খোলামুখ খনিগুলোকে ভালো করে বালি দিয়ে ভরাট করা হয় না। সাতঘরিয়া অঞ্চলে গেলে দেখা যায়, মাটির ফাটল দিয়ে আগুনের শিখা।
লোবা-র কৃষিজমি রক্ষাকমিটির আহ্বায়ক জানালেন, ২০০৫ সালে সেখানে ডিভিসি সেখানে দশটি মৌজার মাটির নিচে খননের বরাত পায়। কিন্তু ডিভিসির কয়লা তোলার যন্ত্র নেই, তাই তারা বরাত দিয়ে দেয় প্রাইভেট কোম্পানি এমটাকে। ২০০৫ সালে বামফ্রন্ট মিটিং করে সেটাকে দেখানো হয় জনশুনানি বলে। সাড়ে ছশো সাতশো একর জমি কিনে নেয় এমটা। ২০০৬ সালে এমটা হঠাৎ মাটি কাটতে আরম্ভ করে। তার প্রতিবাদে ওখানে ধর্নামঞ্চ শুরু হয় এবং মাটি কাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে রাতের অন্ধকারে যখন মাটি কাটার মেশিন নিতে আসে প্রশাসন, তখন সেই ৬ নভেম্বর ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলে লোবা সংবাদের শিরোনামে চলে আসে।
একজন যুবক জানালেন, বাঁকুড়ার মেজিয়ার কিছু দূরে কালিকাপুর গ্রামে খোলামুখ খনি তৈরি করেছিল ইসিএল নিজেই। কিছুদিন পর তা হাতবদল হয়ে আসে শ্যাম স্টিল নামক প্রাইভেট মালিকের হাতে। তারা রাতে ব্লাস্টিং করে গ্রামের মানুষকে অতিষ্ট করে তুলেছিল। খোলামুখ খনিতে প্রচুর জল শুষে নেয়, ফলে এলাকাবাসীকে তুষ্ট করতে এরা জলের কিছু বন্দোবস্ত করে গ্রামে, কিছু মন্দির বানিয়ে দেয়। এখানে চাকরির মাইনে কয়লা ক্ষেত্রের তুলনায় অনেক কম (খোলামুখ খনির মাইনে যে কয়লা ক্ষেত্রের তুলনায় অনেক কম, তা প্রায় সব বক্তাই জানিয়েছিলেন), আশেপাশের কৃষিজমিগুলো ধূলোর দাপটে প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। শাসক দল ঘনিষ্ঠ জনা পঞ্চাশেক গুণ্ডা গ্রামের মধ্যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল। তার সাথেই ছিল চোরাই কয়লাখনি। সেখানে প্রতিদিন লোক মারা যাচ্ছিল। ২০১৪ সালে একটা দুর্ঘটনা হয়, গ্রামের মানুষ বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করতে শুনেছিল। এলাকায় গুজব, কয়েক শো লোক মারা গেছে তখন। কিন্তু প্রশাসনের কাছে কোনো মৃত্যুর খবর নেই। অনিরাপদ জায়গা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পুনর্বাসনের যে বন্দোবস্ত হয়েছে, সে ঘরগুলো জেলের কুঠুরির মতো।
এভাবেই খোলামুখ কয়লা খনির দূষণ, কম মজুরি, এবং দীর্ঘমেয়াদী বিপদ নিয়ে জানাচ্ছিলেন বেশ কিছু মানুষ। আলোচনা সভাটির আয়োজক ‘অধিকার’ সংগঠনের সুদীপ্তা পাল জানালেন, তারা খোলামুখ কয়লা খনির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন কয়লাখনি এলাকার বিভিন্ন বামপন্থী ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। তাদের কথায় খোলামুখ খনির প্রসঙ্গ এল। কয়লা বেসরকারীকরণের কথা এল। এলাকা কয়লাখনি হয়ে যাওয়ায় মানুষকে পুনর্বাসনের প্রকল্পের কথা এল। সিপিআইএম প্রভাবিত সংগঠনের এক কর্তা বিবেক চৌধুরি জানালেন, তারা প্রয়াত হারাধন রায়ের কেস এখনও চালাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু ১৭১ টা মৌজাকে অনিরাপদ ঘোষণা করে কোর্টের পুনর্বাসনের রায় কতদূর বাস্তবায়িত হয়েছে, সেই প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলেন না। অধুনা বিজেপি সরকারের মাইনিং বিল ও নিলাম কয়লাখনির সামগ্রিক বেসরকারিকরণ করছে একথা বলে অনেক বক্তাই জানালেন, আগের সরকারগুলোও এর দায় মুক্ত নয়। আগের ইউপিএ সরকারের আমলে যে কয়লা ব্লক অ্যালোকেশন হয়েছিল (যা সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিয়েছে) তা-ও ছিল প্রাইভেটাইজেশন। এমনকি কয়লা শিল্পের জাতীয়করণের তিন বছরের মধ্যেই বেসরকারীকরণের দিকে হাঁটা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে নয়ের দশকে ইসিএল ষোলোটি প্যাচ আউটসোর্স করে। ইউনিয়নগুলি তখন তার পক্ষে দাঁড়ায়। আলোচনার শিরোনামের উল্লেখ করে দেবল দেব জানান, আমাদের আর কয়লাখনি দরকার নেই। প্রয়োজন বিকল্প শক্তির। তার আগে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা সোমনাথ ব্যানার্জি বলেন, আমাদের এখনো অনেক কয়লাখনি প্রয়োজন।
আলোচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে কয়লাশিল্পের বেসরকারিকরণ ছিল না। কিন্তু তার কথা এসে পড়ে। আলোচনার বিষয়ের মধ্যে ছিল না ঠিকা শ্রমিকদের হাই পাওয়ার কমিটির দেওয়া বেতন কাঠামোও। কিন্তু এই বেতন কাঠামো লাগু করার ব্যাপারে ইসিএল-এর টালবাহানা, তদুপরি এই বেতনকাঠামো আদৌ শ্রমিকের পক্ষে কি না, এর মধ্যে দিয়ে ঠিকা শ্রমিকদের স্থায়ীকরণের দীর্ঘলালিত দাবি বাতিল হয়ে গেল কি না, এসব প্রসঙ্গ-ও এসে পড়ে।
আলোচনার শেষে সুদীপ্তা পাল বীরভূমের পাঁচামি অঞ্চলে যে কয়লা ব্লকের আগামীতে নিলাম হওয়ার কথা, সেখানে একটি সমীক্ষার কথা ঘোষণা করেন। এই ধরনের আলোচনায় আরও একবার বসার-ও আহ্বান জানান।