- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

সদা প্রসন্ন

অমিতাভ সেন, তেহট্ট, ৮ অক্টোবর#

bhyan

বাপী সরকার। বয়স ৬৪ বছর। এখনও বেশ খাটতে পারেন। তবে আগের মতন নয়। মাথায় টাক, মুখে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি-গোফ। নস্যি রঙা পাতলুন আর হাল্কা নীল শার্ট পরে ভ্যান চালাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে একগাল হেসে পথের পাশে ভ্যান থামিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করলেন।

আমি বললাম, — ‘কী খবর আপনার, দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না।’

ফাঁকা ভ্যানে বিচালির টুকরো লেগে আছে। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন,

—- ব্যবসা করছি বিচালি সাপ্লাইয়ের আর গোবর লাঠির, এখন আর প্যাসেঞ্জার তুলি না। বয়স হয়ে গেছে, অত খাটতে পারি না। তাছাড়া মেয়েদের সব ভালো ভালো বিয়ে দিয়েছি — বড়ো মেয়ে দুটোকে বিএ পাশ করিয়েছি, ছোটোটাকে বারো ক্লাস। জামাইরা সব ভালো ভালো কাজ করে — একজনের কাপড়ের ব্যবসা, একজন রোড কন্ট্রাক্টর, একজন প্রাইমারি স্কুলের টিচার — ওরা প্যাসেঞ্জার ভাড়া খাটানোর কাজ পছন্দ করে না, ওদের প্রেস্টিজে লাগে। আমার তো কোনো অসুবিধে নেই। গোবর লাঠি নিয়ে আসি খাসপুর-বয়েরবাঁধা থেকে। তেহট্টে চারটে প্রাইমারি স্কুল ধরা আছে, মাসে দুবার দু-গাড়ি ৬০০ করে গোবর লাঠি সাপ্লাই করি — ওদের মিড-ডে মিলের উনুন ধরানোর কাজে লাগে। তাছাড়া আরও বাড়ি বাড়ি গোবর লাঠি দিই ১০০ থেকে ১৫০-২০০ প্রতিদিন। ১০০ লাঠিতে ৫০ টাকা লাভ — ১ টাকায় কিনে আনি ১.৫০ টাকায় বেচি। আর বিচালি সাপ্লাইয়ের কাজও ভালো চলছে। দিনে এক কাহন মানে ১৬০ আঁটিবিচালি বিক্রি করি। কিনি ৭৫০ টাকায় আর বেচি ৯৬০ টাকায় — ২১০ টাকা লাভ। অনেক দূর থেকেও বিচালি আসে — এমনকী বর্ধমান থেকেও আসে — ফোন করে দিই, ঘরের দোরে এসে বিচালি দিয়ে যায় — বছরভর আসে, আমিও বগলে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সকাল থেকে বেলা অবধি কাজ করি। দুপুরে বিশ্রাম। একটা ছেলে — তাকেও ফুলের দোকানে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। থানার কাছে দোকান। ছেলে ফুলের মালা, তোড়া, সাজসজ্জা সবই করতে পারে, মাস গেলে চার হাজার টাকা মাইনে। বলে খুব হাসেন।
বাপীদা এরকমই। ২৫ বছর ধরে দেখছি। সবসময় বলেন, খুব ভালো আছি। তেহট্টে চাতরপাড়ায় যেখানে ওঁর ঘর, সেখানকার লোকেরা অবশ্য বলে, ‘বাপী সরকার লোক খুব ভালো, তবে কথাগুলো একটু বাড়িয়ে বলে।’ আমার যদিও বাপীদাকে বেশ ভালো লাগে।

ভ্যান থেকে নেমে উনি সজনে গাছের পাতা তুলে নিয়ে যান বিদায় নেওয়ার সময়। আমাকে বোঝান, সজনে শাক প্রেসারের ওষুধ। রসুন পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে খেতে খুব ভালো লাগে। তার সঙ্গে সঙ্গে সজনে গাছের থেকে একটু দূরে নাজনে গাছও চিনিয়ে দেন, বলেন, ণ্ণনাজনের পাতা খাওয়া যায় না — তিতকুটে।’ আমার নাগরিক চোখে সজনে-নাজনের পার্থক্য শিরীষ-খিরীষের মতোই একেবারে গুলিয়ে যায়। শিক্ষা নিতে না পারার লজ্জায় আমার মুখে বোকার মতন একটা হাসি লেগে থাকে যা দেখার জন্য বেলা সাড়ে এগারোটায় নদিয়া জেলার এক মহকুমা শহরের প্রান্তিক রাস্তায় একটা বড়ো বাঁশঝাড় ছাড়া তেমন কেউ নেই।