- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

শ্রমিক-শিশুদের কথা ২ : মুরগির দোকানের হেল্পার কেনা

১২ জানুয়ারি, জিতেন নন্দী#

কেনা, সামাদ আর মেহরাজ — তিন বন্ধু। ওরা থাকে মহেশতলা-রবীন্দ্রনগরের খালপাড়ে সাতঘরায়। মেহরাজ অবশ্য শুধু ওর বন্ধুই নয়, আত্মীয়ও বটে। মেহরাজের পিসির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নন্দীগ্রামের গড়চক্রবেড়িয়ার বাসিন্দা কেনার বাবার। এখানে মেহরাজদের বাড়িতেই সপরিবারে ঘরজামাই থাকে সে। কেনা বলে,  ‘আব্বা বলেছে, গেরামে ইলেকট্রিক এসে গেলেই দিদির বে দেবে ওখানে, আর আমরা গেরামেই চলে যাব।’ যদিও কেনার জন্ম এখানেই।
মেহরাজের রোজকার রুটিনটা ওর মুখ থেকেই শুনেছি।  ‘আমি পড়ি সাতঘরা নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে। ঘুম থেকে উঠি সকাল আটটায়। উঠে মুখ ধুয়ে চা খেয়ে বাজার করি। তারপর ইসকুলে চলে যাই। বাবা তার আগে সাতটার সময় উঠে চা খেয়ে কাজে চলে যায়। বাবা পাকা পোলের ওখানে ম্যানেজারির কাজ করে। মানে কাম-ফাম বাঁধে, হাটে নিয়ে যায়। ইসকুল এগারোটা থেকে, ক্লাস ফাইভে পড়ি। সাড়ে চারটে অবধি ইসকুল। ইসকুলে ভাত, ডিম, সোয়াবিন খেতে দেয়। সপ্তাহে দুদিন ডিম দেয়। বাড়ি এসে খেয়ে খেলতে বেরোই। তারপর সন্ধ্যা হলে ঘরে আসি। মা পয়সা দেয়, আমরিতলা থেকে খাবার আনি। চায়ের সঙ্গে প্যাটিস, মালপোয়া বা হালুয়া। তারপর রাত্রি দশটা অবধি পড়ে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।’
কেনার রুটিনটা আলাদা। ওর চেহারাটা বন্ধুদের চেয়ে ছোটোখাটো হলেও বয়সটা বেশি, তেরো বছর। ও পড়ে আমরিতলা স্কুলে ক্লাস সেভেনে। আমি জিজ্ঞেস করি,  ‘তোর নাম কেনা হল কেন রে?’
ও বলে,  ‘আমার নাম শাহনওয়াজ খান। আমার যখন তিন বছর বয়স, আমার একশিরার ব্যথা উঠেছিল। আমার নানা রেললাইনের কাছে কেনা হাজীর কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। সে বলেছিল, এই ছেলেটার নাম কেনা হাজী দিয়ে দাও, ওর রোগ সেরে যাবে। সেইজন্য আমার নাম হল কেনা। ব্যথাটা কমে গেছিল, কিন্তু ফোলাটা রয়ে গেছে।’
— তোর বাড়িতে কে কে আছে রে?
— আমার ওপরে সবচেয়ে বড়ো ভাইটা মরে গেছে। ওর জন্ডিস হয়েছিল। পুঁইশাক খাওয়া বারণ ছিল। রাত্রিবেলা লুকিয়ে শুকনো পুঁইশাক খেয়ে নিয়েছিল। তার থেকে শরীরে পোকা হয়ে গেল। তারপরে বড়োদিদি। আকড়া হাই মাদ্রাসায় ইলেভেন ক্লাসে পড়ে। তারপরের বোনটা পড়া ছেড়ে দিয়েছে। আমার নিচে দুই ভাই পড়ে ক্লাস ওয়ানে। তার নিচে তিন বছরের ছোটোবোন। বড়োদিদির কাছে আমি পড়ি। ওর কাছে আরও অনেকে ফ্রিতে পড়ে। আর ও আরবি পড়ায় দশ-এগারোজন ছেলেমেয়েকে। তাদের কাছ থেকে একশো টাকা করে নেয়। আব্বা ওস্তাগরের ম্যানেজারি করে। আমার জন্ম এখানে। কিন্তু আগে আমাদের ঘর ছিল নন্দীগ্রামে, গড়চক্রবেড়িয়ায়। ওখানে আমার দিদু, একটা বেটি আর চাচি আছে। আব্বারা ছয় ভাই। সবাই দিল্লি, বোম্বাই আর বাইরে বাইরে থাকে।
— তুই মুরগির দোকানে কী করে কাজ পেলি?
— বকরঈদের সময় মোর আব্বা এয়েছিল ফিরোজের দোকানে মুরগি কিনতে। ও একটা বাচ্চা ছেলের খোঁজ করছিল। আব্বা আমাকে লাগিয়ে দিল। তখন থেকে মুরগির দোকানে কাজ করছি। ডেলি দুবেলা কাজ, বৃহস্পতিবার ছুটি। হপ্তায় তিনশো টাকা ফিরোজ দেয় আব্বা হাতে। আর ফিরোজ আমাকে রোজ দশ টাকা দেয়। ওই টাকা নিয়ে পার্টি করি। পার্টি মানে সবাই মিলে কিছু খাই, এই মশলা-মুড়ি।
রোজ কেনাকে দেখতে পাই রবীন্দ্রনগরের রাস্তার ধারের মুরগির দোকানটাতে। অল্পদিনের মধ্যেই ও বেশ কাজ শিখে নিয়েছে। ফিরোজ দোকানে না থাকলে ও কাটা-মুরগি পিস পিস করে কেটে ওজন করে খরিদ্দারকে দেয়, পয়সাও বুঝে নিতে পারে। সকাল সাড়ে আটটা থেকে বেলা বারোটা, আবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা অবধি ওর হেল্পারি চলে। তারই ফাঁকে চলে ওর স্কুলের পড়াশোনা, খেলাধুলা আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা।