- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

শ্রমিকের চোখে ইটভাটা শিল্প

সুকুমার হোড় রায়, কলকাতা, ৩ আগস্ট#

ইটভাটার ছবি এই ছবির ব্লগের সৌজন্যে।
ইটভাটার ছবি এই ছবির ব্লগের সৌজন্যে।

— য়হা কৈ সড়ক নেহী হ্যায়, সির্ফ পাগদণ্ডী হ্যায়, রোজমরা জিন্দেগী কে লিয়ে আপনা সর-সামান, আনাজ, কাপড়া, লাত্তা যো ভি কুছ, কৈ চীজ কা জরুরত হোগা তো আপকো ইয়ে পাগদণ্ডীমে উতাও-চড়াও করকে বাজার যানা পড়েগা। বাজার নেহি হাট হ্যায়, যিসে মাণ্ডী কহা যায়ে। ও ভি পন্দ্রহা রোজ মে একবার, মাহিনামে দোবার।
এক নাগাড়ে কথাগুলি বলে সরজু প্রসাদ থামলো, আমার মুখের দিকে চোখ মেলে দিয়ে, অপলক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ দেখার পর কোনো প্রতিক্রিয়া জানতে না পেরে আবার সরজু প্রসাদ বলল, — ক্যায়া করু, গরিবি, লাচারি, মজবুরিমে পাপী পেট কে লিয়ে এহী কাম করনে পড়তা, বান্ধুয়া মজদুর গুলাম কি তরহা, একেলা নেহী হু না, বালবাচ্চা পরিবার হ্যায়। ইনসব কো পেট পালানা, খিলানা, পিলানা হ্যায় — বলে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে শুরু করলো।
সরজুর সাথে শিবলাল দু-হাতে থলে, মালপত্তর নিয়ে সরজুর কথা শেষ হতেই বলল,
— বাজার বলিয়ে চাহে হাট বলিয়ে, কম দূর নেহি হ্যায়। তিন চার কিলোমিটার দূরীপে হ্যায়। ও ভি পয়দল চলকে যানা পড়তা, ফির ওয়াপস পয়দল হী আনা পড়তা। রোজানা নেহি, পন্দ্রহা দিনকে লিয়ে আপকো সবজী-মছলি, চাওল-আটা যো চীজ কা জরুরত হ্যায় আপকো মোলনা পড়েগা। পন্দ্রহা দিনমে ফুসরত মিলতে হ্যায়, হাটমে যাকর আনাজ-উনাজ সরসামান খরিদনেকা। রোজানা কমসে কম বারহ ঘন্টা সে ষোলা ঘন্টাতক কাজ করনে পড়তা হাম লোগোকো। আপনা পরিবার বালবাচ্চাকা আপনা গাও মে রহতে হ্যায় কেয়া। নেহি সবকো নেহি। হামলোগোন য্যাসা ভরাই আউর নিকাশি কা করণেবালা মজদুর কী পরিবার, আপনা মেহেরারু, বালবাচ্চা কে লেকর ইটভাট্টা মে কাম করতে হ্যায়। ক্যায়া করু হালত কী মজবুরি। বিবি, বালবাচ্চো কো ভি ইটভাট্টা মে মজদুরি করনে পড়তা।
আপনাদের বাচ্চাদের লেখা পড়া শেখাবেন না?
— বহুত উমীদ থি, লেকিন ক্যায়া করু। ফির ওহি বাত, হালত কী মজবুরি, — শিবলাল, সরজু একসাথে কথাগুলি উচ্চারণ করল। আবার সরজু বলতে শুরু করল,
— দিনভর কাম করনে সে শ’ রুপিয়া মজদুরি, ও ভি ছে মাহিনা কে লিয়ে। দিনমে বারাহ ষোলাহ ঘন্টা কাম, মেহনত করনে থক যাতে হু। রাত মে নিনদ্‌ মে আরাম করণে কা যো ফুরসত মিলতে হ্যায়, উতনি হি ব্যাস। সাল ভরকে লিয়ে দিনভর বারাহ ষোলাহ ঘন্টা কাম, ছে মাহিনা ইধার তো ছে মাহিনা দুসরা কাঁহী আউর মেহনত মজদুরি কা কাম মিলে তো রোটি রোজি, খানে পিনে কা গুজরা হোগা। নেহিতো আপন গাঁও ওয়াপস যা কর ঘর মে বৈঠা রহেনা পড়ে গা।
হতাশায় ভরা শিবলালের করুণ মুখ, অসহায় ভাব তার চোখে ফুটে উঠলো। দুঃখঝরা গলায় সে বলল,
— আপনা বাচ্চোকো যারা পড়ালিখা শিখা পাতা তো বাচ্চা সমঝদার হুঁশিয়ার বন যাতা থা। মগর কেয়া করু গরিবি অউর লাচারি চলতে কর নেহি পায়া। হাম লোগোকা ভাগ মে এহি লিখা হুয়া।
কথাগুলি থেমে থেমে বলেই চিন্তার মধ্যে ডুব দিল।
আপন মনে কিছুক্ষণ চিন্তান্বিত হয়ে থাকার পর বললো, চলে, দের হো গ্যায়া।
আমাদের দেশের সরকারের শিল্প ও শ্রম দপ্তরের দৃষ্টিতে যে শিল্প, শিল্প হিসেবে গণ্য হয়না, তা হল ইটভাটা। এক একটি ইটভাটায় খুব কম করে দুশ’ থেকে আড়াইশ’ জন শ্রমিক কাজ করে। শোনা যায়, বছরে কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা করে এই শিল্পের মালিকরা। মালিকদের অ্যাসোসিয়েশন আছে, কিন্তু শ্রমিকদের ইউনিয়ন নেই। সরজু-শিবলালের সঙ্গে কথা বলে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমদিকের জেলাগুলির ইটভাটাগুলির সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানা গেল। কাজের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুসারে ছয় প্রকার শ্রম বিভাজনে ইটভাটা শ্রমিকদের কাজ করতে হয়।
১) পথাই ২) ভরাই ৩) বেলদার ৪) নিকাশি ৫) জলাই ৬) রাবিশ।
কাজের ধরণ ও শ্রম বিভাগ অনুসারে পৃথক পৃথক ভাবে গড়ে ওঠে, গড়ে তোলা হয় এদের বসতি। ছ’ থেকে সাত ফুট উঁচু এ্যাসবেসটসের চাল দেওয়া ঘরে, ইটভাটার মজুররা একা বা তাদের পরিবার নিয়ে থাকেন। একই ইটভাটাতে কাজ করা সত্ত্বেও শ্রম বিভাগের দরুন, পরস্পরের সাথে বা এক বিভাগের শ্রমিকের সাথে অন্য বিভাগের শ্রমিকের কোনও সম্পর্ক থাকে না। রাখতে পারে না।
ইটকে আগুনে পুড়িয়ে পাকা করা হয়। ভাটিতে, আগুনে কাজ করেন যারা, সেই শ্রমিকদের গ্রীষ্মকালে গরমে ভয়ংকর কষ্ট হয়। যারা এই কাজ করে, তা শুধু তারাই বোঝে। প্রতিদিন ৬ ঘন্টা করে দুটি শিফটে ১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়।
ইটভাটাগুলির এক একটি বিভাগের শ্রমিকরা, এক একটি অঞ্চল বা ‘জিলা’র মানুষ। সকলে একই অঞ্চল বা জিলার নয়। যারা আগুনে ইট পুড়িয়ে পাকা করে তারা উত্তর প্রদেশের প্রতাপগড় জিলার সরোজের দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। যারা রাবিশে কাজ করেন, তারা উত্তর প্রদেশের ফতেহপুর জিলার প্রজাপতি জাতির মানুষ। পথাই (ইট তৈরি) কাজ যারা করেন, তাদের অধিকাংশই হল পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার, উত্তরপ্রদেশের মিরাট, বাগপত, শালমি জিলার মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ।
১০ থেকে ৭০ বছরের মানুষ এই ইটভাটাগুলিতে দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা এক নাগাড়ে কাজ করার পর রাতে পাঁচ থেকে ছ-ঘন্টা শুয়ে ঘুমাবার জন্য বিশ্রাম পায়। নিকাশি ও ভরাইয়ের কাজ যারা করে, তারা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে ইটভাটাতে থাকেন শুধু। অন্যান্য বিভাগের শ্রমিকরা নন। নিকাশি ও ভরাই শ্রমিকদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা এই কাজে নিজেদের যুক্ত করে মজুর হিসেবে। দু-বেলা দু-মুঠো খেয়ে পরে বাঁচার তাগিদে। হাজার ইট মাথায় করে বয়ে এনে সাজাবার জন্য দৈনিক আশি থেকে একশ’ টাকা মজুরি পায় এরা। নিকাশি শ্রমিকরা শুধু দৈহিক শ্রমই দেয় না, নিকাশি কাজের জন্য তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়। আশি হাজার থেকে এক লক্ষ টাকায় ঘোড়া কিনতে হয় তাদের নিকাশির কাজ করার জন্য। সারা ভারতে ছোটো বড়ো মিলিয়ে প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজারের মতো ইটভাটা আছে। চল্লিশ থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ লক্ষ শ্রমিক এই ইটভাটাগুলিতে কাজ করে।
যেখানেই ইটভাটা গড়ে ওঠে, তার আশে পাশের জমি আর কৃষির উপযোগী থাকে না। ইটভাটার জন্য কৃষিজমি কৃষির অযোগ্য হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রীম কোর্ট আদেশ জারি করে, ইটভাটার জমির ভূ-স্তর পাঁচফুট পর্যন্ত কাটার জন্য রাজ্য সরকারকে পঞ্জীকরণের মাধ্যমে অনুমতি দিতে হবে। তবে বানানো যাবে ইটভাটা। পঞ্জীকরণের মাধ্যমে অনুমতি পাবার জন্য ইটভাটার মালিকদের অনেক চড়া দামে জমি কিনতে হবে, যা বর্তমান ইটভাটা মালিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের পুঁজির জোর অত বেশি নয়। ফলে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, গুজরাট ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশের ইটভাটাগুলি বন্ধ হবার উপক্রম। শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে নির্মাণ শিল্প, বাড়ি-আবাসন নির্মাণের কাজে চলে আসছে। এর ফলে মালিক-ঠিকাদাররা লাভবান হচ্ছে। তারা শ্রমিকদের কম মজুরিতে তাদের শ্রম বেচতে বাধ্য করাচ্ছেন। ইটের দামও বেড়েছে পাঁচ থেকে ছয়গুণ হারে।
সারা ভারতে ইট তৈরি শিল্পে বছরে চার হাজার কোটি টাকার মতো ব্যবসা হয়, সেই কারণে বড়ো পুঁজিরও এই শিল্পের দিকে নজর আছে। সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশে বিদেশি প্রযুক্তি নির্ভর, পুঁজি-নিবিড় ইটশিল্পের কারবারি বড়ো পুঁজির সুবিধা হওয়ার কথা।