- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

শুধু তামিল কাঠুরেরাই মরে; রক্তচন্দন মাফিয়া, অপারেটর, দালাল, আশ্রয়দাতাদের টিকিটি ছোঁয়না পুলিশ

এম সুব্বারাও-এর নেতৃত্বে মানবাধিকার কর্মীদের একটি দল ২০১৪ সালে রক্তচন্দন গাছ কেটে রপ্তানির বেআইনি কারবার এবং তার সাথে দিনমজুরদের হাজতবাস এবং পুলিশের গুলিতে মৃত্যু বিষয়ক তদন্ত করে। ওই বছরই দেখা যায়, মোট সাত জন দিনমজুর পুলিশের সাথে ‘সংঘর্ষে’ মারা গেছে। প্রায় ২০০০ জন কাডাপ্পা জেল-এ বন্দী। অক্টোবর মাসে প্রকাশিত রিপোর্টের সম্পাদিত অংশ অনুবাদ করা হলো। অনুবাদ ও সম্পাদনা শমীক সরকার। ১৩ এপ্রিল। রিপোর্টের ইউআরএল http://www.academia.edu/7732495/who_are_the_Red_Sander_Smugglers_

রক্তচন্দন গাছ কাটা ও পাচারের দায়ে ধৃত হাজার হাজার কাঠুরেদের মধ্যে একটি দল। ছবি সুব্বারাও-এর তথ্যানুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে।
রক্তচন্দন গাছ কাটা ও পাচারের দায়ে ধৃত হাজার হাজার কাঠুরেদের মধ্যে একটি দল। ছবি সুব্বারাও-এর তথ্যানুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে।

২০১৪ সালের ২৯ মে জঙ্গলে পাথরের মধ্যে তিনজন ভানিয়ার কৌমের যুবকের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তারা সবাই জাভাদি পাহাড়ের কাছে দানিয়ার আত্তামুর গ্রামের। তাদের-ও আগে ধরে নিয়ে গিয়ে, অত্যাচার করে, তারপর মেরে ফেলে রেখে দিয়েছিল পুলিশ। পাশে রেখে দিয়েছিল অস্ত্রশস্ত্র এবং কিট ব্যাগ। যদিও পুলিশের বয়ান ছিল এরকম, গভীর রাতে গাছ কাটার খবর পেয়ে জঙ্গলে গিয়ে পুলিশ তিনশো জনের একটি দলের মুখোমুখি হয়, যারা তীর ধনুক নিয়ে আক্রমণ করে পুলিশকে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায়। (উল্লেখ্য, এবারও পুলিশ এরকমই একটা বয়ান দিয়েছে)। ২১ জুন ২০১৪ সালে এ ভিরামণি (৩৫) নামে একজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার বাড়ি তামিলনাড়ুর তিরুভান্নামালাই জেলায়। অন্ধ্রের বনরক্ষীদের গুলিতে এপ্রিল মাসে চিত্তুর জেলার মিত্তাপালেম গ্রামের একজন ব্যক্তি মারা যায়। জানুয়ারিতে আরো দু-জনের মৃত্যু হিসেব করে মোট সাতজন মারা যায়।

২০১৪ সালে তদন্তের সময় দেখা যায়, তামিলনাড়ুর মূলত চারটি জেলা থেকে — তিরুভান্নামালাই, সালেম, ধরমপুরি, এবং ভিল্লুপুরম জেলা থেকেই বেশিরভাগ দিনমজুর আসে অন্ধ্রপ্রদেশের সেশাচলম জঙ্গলে রক্তচন্দন গাছ কাটতে। মোট তিরিশটি গ্রামের থেকে লোকে আসে। তামিলনাড়ু হিউম্যান রাইটস ফোরামের একজন সংগঠক জন ব্রেটো সালেম জেলার ইয়েরকৌদ-এর কাঠুরেদের বিষয়ে জানান, মারামঙ্গলম পঞ্চায়েতের ষোলোটি গ্রামের কাঠুরেরা রক্তচন্দন দস্যুদের খপ্পরে। গ্রামগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কুথামেদু, সোনাপডি, কুটুমুথাল, আরাঙ্গাম, এবং ভাঝাভাণ্ডি। প্রতি মাসে শ’য়ে শ’য়ে কাঠুরে তিরুপতির জঙ্গলের দিকে যায় — কেউ কেউ টাকা পয়সা নিয়ে ফেরে। কারোর ঠাঁই হয় কাডাপ্পা জেল-এ।

map

যেমন, ৩২ বছরের কে সুব্রামানি, সাত্তুকাডু জেলার। তিনটি ছোটো বাচ্চার বাবা ছ’মাস বাড়ি ফেরেনি। তার বাবা কুপ্পু সামি জানান, ‘সে কাডাপ্পা জেল-এ আছে, আমরা ওর জামিনের চেষ্টা করছি।’ কুটুমুথাল গ্রামের ভি রামাচন্দ্রন-ও কাডাপ্পা জেল-এ বন্দী আছে। তার বাবার শেষকৃত্যে সে হাজির থাকতে পারেনি।

জন ব্রেটোর মতে, ইয়েরকুদ-এর কাঠুরেরা সারা তামিলনাড়ুর সবচেয়ে দ্রুত গাছ কাটতে পারে। গাছ ফেলতে ও ঝুরতে তারা মারাত্মক দক্ষ। তারা খুব দ্রুত হেঁটে যেতে পারে। মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মাইলের পর মাইল দ্রুত হেঁটে যেতে পারে। দশকের পর দশক ধরে তারা কফি বাগানের মালিকদের হয়ে এস্টেটের সিলভার ওক গাছ কাটার কাজ করেছে। কিন্তু এখন রক্তচন্দন মাফিয়ারা তাদের প্রচুর টাকা আগাম দিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে আসছে। এই কাঠুরেরা ইয়েরকুদ-এ প্রতি বর্গফিটের জন্য ২০-৩০ টাকা করে পায়। কিন্তু রক্তচন্দন মাফিয়ারা তাদের প্রতি কেজি কাঠের জন্য ৫০০ টাকা করে দেয়। ‘রক্তচন্দন মাফিয়াদের দালালরা এই কাঠুরেদের প্রচুর টাকা আগাম দিয়ে তিরুপতি নিয়ে আসে। আগে ওই দালালদের গ্রেপ্তার করা উচিত।’

রক্তচন্দন ব্যবসায় এই গাছ কাটা, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বওয়া, এবং গাড়িতে তুলে দেওয়ার কাজ যারা করে, তারা হলো প্রথম স্তর। এদের নেতা থাকে একজন, সে মিস্ত্রি। এরপর যারা গাড়িতে করে নিয়ে যায় কাঠ, সেই ড্রাইভার বা পাইলটরা হলো দ্বিতীয় স্তর। যারা এগুলো রপ্তানির কাজ করে এবং লেবার কনট্রাকটর ও অপারেটর, তারা তৃতীয় স্তর। আর এইসমস্ত কার্যাবলী কো-অর্ডিনেট করে যারা — তাদেরই টাকা খাটে এবং তারাই সুরক্ষা জোগায় এই তিন স্তর-কে। সেটি চতুর্থ স্তর। এই চতুর্থ স্তরটি সমস্ত কাজগুলো সরাসরি নিজেরা দেখভাল করে না। এদের লেবার কনট্রাকটর ও অপারেটরদের মাধ্যমে এই কাজ করে। তারাই পুলিশের সঙ্গে রফা করে, চোরাপাচার যাতে ঠিকঠাক সমাধা হয় — তা দেখে।

প্রথম স্তরটিকে জঙ্গলের এবং আশেপাশের স্থানীয় গ্রামবাসীরা সাহায্য করে, রাস্তা দেখিয়ে দেয়, খাবার দাবার ও জল সরবরাহ করে, কাঠগুলি লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। দ্বিতীয় স্তরটিকে সাহায্য করে পুলিশ ও বনদপ্তরের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মীরা। যদি এক টন করে কাঠ বয়ে নিয়ে যাওয়া দুটি গাড়ি ধরা পড়ে বড়ো রাস্তায় — তবে আটটি গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছে যাবে নিরাপদে — এরকমই বোঝাপড়া থাকে ডিপার্টমেন্ট এবং পাচারকারীদের মধ্যে।

ভারতের বাজারে রক্তচন্দনের দাম কেজি প্রতি ২০০০ — ৫০০০ টাকা। চীনে সেই কাঠেরই দাম কেজি প্রতি এক লক্ষ টাকা। ভেলোরের এক বনদপ্তরের অফিসারের মতে, ‘এক টন রক্তচন্দন কাঠ ভারতে বিক্রি করে যদি কুড়ি লাখ টাকা হয়, বিদেশে তার দাম পঞ্চাশ থেকে আশি লাখ টাকা। জাহাজের কন্টেনার বা উড়োজাহাজের কার্গো হিসেবে এগুলো পাচার করা হয়। অনেক সময় চেন্নাই-কুয়ালালামপুর বা দিল্লি-বেজিং বিমানযাত্রীরা লাগেজ হিসেবে রক্তচন্দন পাচার করে’। কাঠুরেরা ছয় ফুট কাঠের টুকরোর জন্য তিন হাজার টাকা মতো পায়। দালালরা পায় পঁচাত্তর হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা, কমিশন হিসেবে। সবচেয়ে বেশি কামায় চতুর্থ স্তরটি। ভারতে রক্তচন্দদের খুব একটা চাহিদা নেই। কিন্তু চিন, মায়ানমার, জাপান এবং পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে ওষধি ও কাঠের কাজের জন্য এটা কাজে লাগে। জাহাজ কারখানাতেও ব্যবহার হয় রক্তচন্দন। এমনকি পরমাণু চুল্লির বিকিরণ প্রতিরোধেও এই কাঠের ব্যবহার হয় বলে জানা যায়।

২০১৪ সালের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ২০০০ জন রক্তচন্দন গাছ কাটা ও পাচারের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে জেল-এ আছে। এদের বেশিরভাগকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে ট্রেন, বাস, বাস স্ট্যান্ড এবং রেল স্টেশন থেকে। কাউকেই প্রায় হাতে নাতে ধরা হয়নি। এদের ঠাঁই হয়েছে নেলোর এবং চিত্তুর জেলার জেলগুলোতে। এদের মধ্যে চারজন অপ্রাপ্তবয়স্ক। নেলোরে একজন জেল-এ থাকাকালীনই মারা গেছে।

নেলোর এবং কাডাপ্পা জেল-এ অনুসন্ধান করে দেখা যাচ্ছে, দুটি জেল-এ মোট ৪৪০ জন আটক আছে রক্তচন্দন গাছ কাটা ও পাচারের কেস-এ। তার মধ্যে ২৩৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যার মামলা আছে, বাকিদের বিরুদ্ধে হত্যার চেষ্টার মামলা আছে। আটকদের বেশিরভাগই তামিল। এরা সবাই প্রথম স্তরের বা দ্বিতীয় স্তরের। কিন্তু তৃতীয় স্তরের লোক, যারা লেবার কনট্রাকটর ও অপারেটর, তারা কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। এই অপারেটররা জঙ্গলের আশেপাশের গ্রামগুলোতে দূর থেকে আসা কাঠুরেদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে, খাবার দাবার জোগাড় করে দেয়, লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে। এরা এলাকার লোককে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখে।

রক্তচন্দন মাফিয়ারা ভেল্লোর এবং সালেম-এর গ্রামগুলো থেকে দালাল মারফত কাঠুরেদের নিয়োগ করে। এরা চন্দ্রগিরি মণ্ডলের অন্তর্গত শ্রীভারিমেত্তু, বাকারাপেটা গ্রামের মধ্যে দিয়ে জঙ্গলে ঢোকে। তাই তামিল কাঠুরেদের চন্দ্রগিরি মণ্ডলের পানাপাকাম, মুঙ্গালিপাত্তু, নাদিমপাল্লি, আইথেপাল্লি গ্রামে প্রথমে আসতে হয়। পুলিশ এবং বন দপ্তরের কাছে বিস্তারিত তালিকা আছে, কারা কারা এই কাঠুরেদের সাহায্য করে। কিন্তু তাদের কেউ কখনো সাজানো সংঘর্ষে মারা যায় নি বা গ্রেপ্তার হয়নি এখনো অবধি।

হিসেব বলছে, এই তৃতীয় স্তরে রয়েছে ১০০ জনের মতো। চন্দ্রগিরি মণ্ডলের এই একশো জন বা তাদের সাগরেদ — কারোর টিকিটি ছোঁয়নি পুলিশ বা বনদপ্তর। কারণ তাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ও টাকা। এখানের গ্রামগুলোর নিচু জাতের কলোনি গুলোতে কুটির শিল্প হলো এই তামিল কাঠুরেদের রাখা। দালালরা তাদের রাখতে বাধ্য করে। কখনো কখনো গ্যাঙের মধ্যে বিরোধ বাধে। তখন মামলা হয়। কিন্তু পুলিশ কাউকে কিচ্ছু বলে না। সবসময় কাঠুরেদের বা ড্রাইভারদের গ্রেপ্তার করা হয়, এবং তা দেখানো হয়। কিন্তু তাদের মোবাইল ঘাঁটলেই যে তৃতীয় স্তরের খোঁজ পাওয়া যায়, সেটুকুও করে না পুলিশ। স্থানীয় গ্রামগুলিতে যারা কাঠুরেদের আশ্রয় দেয়, তাদেরও কখনো গ্রেপ্তার করে না পুলিশ।