- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

শান্তিপুর বাগআছড়ায় এক অন্য মেলা

নিরুপম ভট্টাচার্য, শান্তিপুর, ২৭ মে#

ছবি ফারুক উল ইসলামের তোলা।
ছবি ফারুক উল ইসলামের তোলা।

মেলা বলতে যা বোঝায়, তেমন নয়। তাই শিরোনামটা দেওয়া হল — এক অন্য মেলা।
তেমন অর্থে এই মেলার নাম নেই।
কারণ যারা এই মেলায় আসে, তারা বলে, এটা আমাদের মেজোদের মেলা। আসলে একটা নাট্যকর্মশালা। নিজেদের গ্যাঁটের খরচ দিয়ে গ্রীষ্মের তাপ উপেক্ষা করে বিছানাহীন বিছানাতে শুয়ে কিংবা আলুসেদ্ধ ভাত ডাল খেয়ে কুড়ি পঁচিশ জন মানুষ অনায়াসে শান্তিপুর বাগআছড়া উচ্চবিদ্যালয়ে কাটিয়ে দিল ১৮ মে থেকে ২২ মে পর্যন্ত।
প্রশ্ন জাগে — কেন, কীসের জন্য?
কেনইবা মোদী জ্বরে দেশের বিরাট অংশের মানুষ যখন দোদুল্যমান, তখন মাত্র বাইশ পঁচিশ জনের মতো মানুষ তৃণদলের মতো মরেও মরে না। কেন, কতটা এদের শেকড়ের জোর? উত্তরটা এই মেলার ফ্যান-না-ঝাড়া গলা-ভাতের মতো প্রায় মুখে দেওয়ার আগেই পাকস্থলীতে পৌঁছে যাওয়ার মতো সহজ নয়।
তাহলে কীসের টানে এরা মেলে? শুধু একটা নাটকের ক্যাম্প হচ্ছে? যেখানে রেডিমেড বিখ্যাত অভিনেতা তৈরি হবে বলে?
উত্তরটা, না।
তাহলে? ও, নাটকের ক্যাম্প যেহেতু, অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার সুযোগ আছে, তাই ওরা আসে।
উত্তরটা আংশিক সত্য হলেও পুরোটা না।
তাহলে কীসের জন্য?
বুঝেছি, একটা আধ-কাঁচা আধ-পাকা চুলের মানুষ আছেন, যিনি বিশ্বাস করেন এবং জোরের সাথে বলেন এক বিখ্যাত চৈনিক দার্শনিকের কথা। তিনি বলেছেন, ‘সবচেয়ে সফল নেতা হচ্ছেন তিনি, যাঁর উপস্থিতি প্রায় বোঝাই যায় না। যখন তাঁর কাজ শেষ হয়, তাঁর লক্ষ্য পূরণ হয়, তখন অন্যরা বলে, আমরা নিজেরাই এটা করতে পারলাম’ (লাও ৎজু)।
কিন্তু এই সময় দাঁড়িয়ে এটা মানা সম্ভব? মানছি এই কথা শুনতে বেশ ভালো লাগে, তত্ত্ব কথা ভেবে। কিন্তু যখন চারপাশ থেকে প্রচার আসে ‘তোমার পরিচয় তোমার বাড়ি’ কিংবা ‘তোমার গাড়ি’ অথবা যখন দেখি বিলাসবহুল বাড়ির সামনের ঝুপড়িতে টিবি রোগী মায়ের পাশে শুয়ে খিদের জ্বালায় যন্ত্রণায় কাঁদছে সদ্যোজাত শিশু। কিংবা যে স্কুলে এই মেলা সেই বাগআছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের মাধ্যমিকের রেজাল্ট নিতে আসা একটি মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে যায় মেয়েটির গ্রামেরই একটি ছেলে, তার অবদমিত কামের ইচ্ছায়।
আর তখনই আরেকজন মানুষ টানা আড়াই ঘন্টা ক্লাস নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তোমার সামনে অনেক বাধা, তা তুমি টপকাতে পারো, শুধু তোমার অলসতা, অধৈর্য্য ও অমনোযোগিতা দূর করে। যখন প্রায় সবাই বলবে, তোর দ্বারা কিছু হবে না, তখন তুমি মনে মনে বলো, ডু ইট নাও ফর টুমরো। সত্যই কথাগুলো প্রায় অমৃত সমান।
কিন্তু কীভাবে?
তারই খোঁজ করবার বীজ বপন হয় কিন্তু এই মেলায়। তথাকথিত প্রচার এখানে নেই। নেই কালকেই পুরো এসে বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়ার ডাক। তবে যা এখানে আছে, তা আগামী দিনে চারপাশটা বিচার করবার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আমাদের। বাকরাহাটের সঙ্গে রানাঘাটের যোগসূত্র তৈরি করে। আর পাশের মানুষটি যদি খারাপ কিংবা ভালো থাকে, তাহলে তার সঙ্গে আমার অনুভূতি দিয়ে বোঝার চেষ্টা থাকে এই মেলায়।
তাই শেষে কবি বলেন, ‘জানো গায়ক, এমন সুরে গাও তুমি/ মৃত্যু তখন অনেক দূরে/ যদিও দিন ফুরোলে সন্ধ্যা নামে/ যবে তুমি একলা হলে/ মৃত্যু তোমার দ্বারের কাছে/ তবু তুমি সুর ভাঁজো/ ইমন বসন্ত ভৈরবী গীতে/ মৃত্যু তখন দাঁড়িয়ে হাসে/ তুমি বলো, সত্যমেব জয়তে।’