- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

শব্দবাজি : যান যান যা পারেন করুন, বায়োডাটা দিয়ে দিচ্ছি

dd

আমরা আর বাজি ফাটাবো না …
উত্তর চব্বিশ পরগণার কাঁকপুল – কল্যানগড় অঞ্চলের একটি মোটামুটি জনবহুল রাস্তার পাশে আমার বাড়ি। বাড়ির কাছাকাছি একটা কালভার্টে এলাকা এবং আশেপাশের কিছু উঠতি বয়সের ছেলেছোকড়া সকাল বিকাল আড্ডা জমায়। সবাই মোটামুটি অভাবী পরিবারের ছেলে। কেউ কেউ নিয়মিতভাবে ছোটোখাটো হাতের কাজকর্ম করে। পূজা পার্বনে বিশেষত লক্ষ্মী ও কালীপূজায় বাজি পোরানো এদের একটা অভ্যাস। কয়েকবছর যাবৎই ভাবছি, ওদের বাজি না ফাটাতে বলব। কিন্তু ভরসা করে বলা হয়নি। — কাজ হবে কিনা ভেবে দ্বিধায় দ্বন্দ্বে পিছিয়ে এসেছি বারবার। এবারও কালীপূজার দু-দিন পর ৫ নভেম্বর সন্ধ্যের পর জনা দশবারো ছেলে বাজি পোড়াচ্ছিল। মুহুর্মুহু শব্দবাজিতে ঘরে টেঁকা দায় হলো। অনেকক্ষণ দরজা জানলা বন্ধ রেখেও সহ্য করা যাচ্ছিল না। সেই দিনই দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার পাতায় শহরতলীর বাতাসে শব্দবাজিতে যে বিষ ছড়িয়ে গেছে তার খবর বেড়িয়েছিল। আবার কালীপূজাতেই অশোকনগরের নামটা বড়োবড়ো সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছে, কালীপুজোর রাতে বাড়ির সামনে এক পূজায় বাজি ফাটানোর প্রতিবাদ করেছিলেন অশোকনগর সুকান্ত পল্লীর পিন্টু বিশ্বাস নামে একজন। তার ফলে সেই রাতেই তাকে ছেলেপেলেরা ‘মায়ের ভোগে’ পাঠিয়ে দিয়েছে।
শেষমেশ এত কিছুর পরও শব্দের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রাত ন’টা সাড়ে ন’টা নাগাদ সংবাদপত্রটি হাতে নিয়ে ওদের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, তোরা একটু বাজি ফাটানো বন্ধ কর। আশেপাশের অন্যরাও তাদের বাজি ফাটাতে নিষেধ করল। ওরা বাজি ফাটানো বন্ধ করে আমার দিকে মনোযোগ দিতেই খবরের কাগজের হেডিং-টা ওদের পড়ে শুনিয়ে বললাম, — দ্যাখ তো রাস্তার চারপাশ কেমন ধোঁয়ায় ভরে গেছে, আর এই ধোঁয়ার বিষ তোরা যেমন টানছিস। তেমনি আমরা সবাই তা শ্বাসের সঙ্গে টানতে বাধ্য হচ্ছি। এই সময়ই হাসপাতালে কত লোক শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভরতি হয়, আবার অনেকে বাজি ফাটাতে গয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। দ্যাখ তোরা পইয়সা খরচ করে, যে বাজি ফাটাস, তাতে যে বিকট শব্দ হয়, এর কি কোনও সুর তাল আছে? মানুষ গান বাজনা ভালোবাসে কারণ তার সুর তাল ছন্দ আছে … ওদের মধ্যে একজন বলল, কাকু আমরা তো এখন ইয়ং, এই সময় এগুলো ভালো লাগে। আর একটু কথা এগোতে ওদের আন্তরিকভাবে বারে বারে দুঃখ প্রকাশ করল, কাকু অন্যায় হয়ে গেছে, আমরা আর বাজি ফাটাবো না কথা দিলাম। ওরা ওদের কথা রেখেছে, সেদিন তো নইয়ই, এর পরে কদিনও ওরা আর বাজি পাঠালাম। আমি ওদের প্রতি কৃতজ্ঞ রইলাম।
সংলাপে স্বপন গোস্বামী, কল্যানগড়

যান যান যা পারেন করুন, বায়োডাটা দিয়ে দিচ্ছি
লক্ষ্মীপূজার রাতে কল্যানগড় এলাকায় বাজি ফাটানোর ধুম পড়ে। চারদিকে ধোঁয়াশায় ছেয়ে যায়। পূর্ণিমার চাঁদ ঢেকে ফেলে বিষাক্ত বাতাস। এক মুহুর্তের জন্যও শব্দের বিরাম নেই। লাগাতার বাজি ফাটতে থাকে। সন্ধ্যেবেলা রাস্তা দিয়ে সাইকেলে যাচ্ছি, আশপাশ থেকে মজা করে সাইকেলের সামনে বাজি ছুঁড়ে দিচ্ছে। কিছু ছেলে কয়েকটা বাড়ির দিকে টার্গেট করে শব্দবাজি ছুঁড়ছে। দুম দাম অসহ্য শব্দ। ওদের সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। শান্তভাবে বললাম, দ্যাখো, তোমরা ওইদিকে বাজি ছুঁড়ছ কেন? বললাম, ওখানে একটা গর্ভবতী মেয়ে আছে, এই বিকট শব্দে মায়ের পেটের শিশুটিরও ক্ষতি হয়। চড়া স্বরে উত্তর, যান যান জ্ঞান দেবেন না, বলেই আমার পায়ের কাছে ওদের একজন বাজি ছুঁড়ে দিয়ে সরে গেল। তোমরা এমন করছ কেন! ফের ঝাঁজের সঙ্গে বলল, যা পারেন করুন, বায়োডাটা দিয়ে দিচ্ছি। ওদেরই দলের একটি ছেলে আমাকে বলল, ফালতু ঝামেলা করছেন কেন, চলে যান। বলে আমায় জোর করে টেনে সরিয়ে দিতে থাকল। বাকি ছেলেরা উল্লাসে বাজি ফাটাতে থাকল। আমি সাইকেলে উঠতেই পিছন থেকে বাজি ছুঁড়ে দিল। ঘরে ফিরে বন্ধুদের এসএমএস পাঠালাম, এমন কিছু শব্দ দিতে পারো যাতে কোনও শব্দ নেই… স্তব্ধ আমি, শব্দে শব্দে ক্লান্ত …
সংলাপে বঙ্কিম, কল্যানগড়

এ আর কী দেখছেন, কলকাতা থেকে বস্তাবস্তা বাজি আনা হয়
কল্যানগড়ে আমার বাড়ির কাছাকাছি এক বাড়িতে কালীপূজা হয়ে গেছে। দু-দিন বাদের সকালবেলা গিয়ে দেখি, সারা উঠোনে বিভিন্ন ধরণের বাজির খোল, এবং পোড়া ছাইয়ে ছেয়ে আছে। স্বতস্ফুর্তভাবে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, এত বাজি পোড়ানো হয়েছে! ওই বাড়ির এক মহিলা গর্বভরে বললেন — এ আর কী দেখছেন, এবার তো মাত্র বারো হাজার টাকার বাজি এসেছে। অন্যান্যবার বিশ হাজার টাকার বাজি আসে, কলকাতা থেকে বস্তাবস্তা বাজি আনা হয়। এইবার বাড়িতে একটা বাচ্চা মেয়ের হাত পুড়ে দুর্ঘটনা ঘটে গেল, তাই … পাশের বাড়ির মহিলা বললেন, কালীপুজোর রাতে ঘরের দরজা জানলা কাঁপছিল, বাইরের বাথরুম পায়খানা ছাইয়ে ভরে গেছিল। ওই মহিলা কিন্তু গর্ভবতী।
সংলাপে বঙ্কিম, কল্যানগড়

বাজি ফাটাচ্ছে … শান্তশিষ্ট লক্ষ্মী মেয়ে সে যে
এতদিনে পূজা কেটে গেছে। কিন্তু কল্যানগড়ে পূজার শেষ নেই। সেই দূর্গাপূজা থেকে শুরু হয়, জগদ্ধাত্রী পূজা শেষ হয়েও শেষ হয় না।
আমার হৃদরোগী বাবা (৭৬), পেসমেকার লাগানো, স্ট্রোকের পরও এবারের বাজির ধাক্কা সামলে নিয়েছেন। আর এক হৃদরোগী আমার মুমুর্ষু মামা (৬৭) দু-দুবার ওপেন হার্ট সার্জারির পরও টিঁকে আছেন। তিনদিনের জন্য এসেছেন, আমাদের বাড়ি বেড়াতে। আচমকা দিনে দুপুরে দুমদাম বাজি ফাটতে শুরু করল। ওরা চমকে উঠছে। এ বয়সেও ওদের কানগুলো যায়নি। বেশ শুনতে পায়। দ্রুত ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে বাইরে এসে দেখি, অবাক কাণ্ড, একী বিস্ময়। বাজি ফাটাচ্ছে এ কে? আমারই পাশের বাড়ির শান্ত-শিষ্ট, লক্ষ্মী মেয়ে সে যে।
সংলাপে বঙ্কিম, কল্যানগড়