- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

লাগাতার বনধের ঘেরাটোপে থাকা নেপালের পথে

অলকেশ মণ্ডল, বদ্রীবাস, নেপাল, ৩১ আগস্ট#

থারু মহিলাদের অবরোধের ছবি নেপালের সংবাদপত্রের সৌজন্যে।
থারু মহিলাদের অবরোধের ছবি নেপালের সংবাদপত্রের সৌজন্যে।

কাজের সুবাদে মাসে ১-২ বার নেপাল যেতে হয়। এইবারেও পৌঁছালাম ২১ আগষ্ট। যারা নেপালে ছিল তারা ফোনে বনধের কথা জানিয়েছিল। ইন্টারনেটের মাধ্যমেও জেনেছিলাম যে হিন্দুরাষ্ট্রের দাবিতে একদিনের বন্ধ ডেকেছে। কিন্তু যা ভেবেছিলাম তা ছাড়াও অন্য গল্প আছে। শুনলাম ‘মধেসী’রা অনির্দিষ্টকালের জন্য বনধ্‌ ডেকেছে। এর আগে মাওবাদীদের ডাকা এইরকম বনধ্‌ দেখেছি। কিন্তু রাজতন্ত্রের অবসানের পর তেমন দেখিনি। যদিও নতুন সংবিধানের দাবিতে কয়েকবার বনধ্‌ হয়েছে। আমরা যাদের দেখলেই নেপালী বলে চিনতে পারি সেই গোর্খাদের ‘পাহাড়ি’ আর সমতলের বা তরাই অঞ্চলের অধিবাসীদের ‘মধেসী’ বলে। ‘হিমালি’ নামেও আর এক গোষ্ঠী আছে। মধেসীদের সাথে ভারতীয়দের চেহারায় মিল আছে। বিবাহ বা পৈতৃকসুত্রে ভারতেরও ঘনিষ্ঠ এঁরা।
মধেসীদের অধিকার আন্দোলনের কথা অনেকদিন ধরেই শুনছি। কিন্তু তাদের লাগাতর বনধ্‌ সম্ভবত প্রথমবার। মধেসীদের সুযোগ-সুবিধা নাকি পাহাড়ীদের তুলনায় কম। নতুন সংবিধানে নাকি আরও সুবিধা হারাতে চলেছে। ভারতীয়দের সাথে বিবাহসুত্রে জন্ম নেওয়া মানুষদের নেপালী নাগরিক হবার পুরানো নিয়ম খর্ব করা হয়েছে। নেপালের নাগরিক হওয়া সত্বেও নতুন সংবিধানে এদের প্রশাসনে বা অন্য উচ্চপদে আসীন হবার মান্যতা দেওয়া নেই। আরও শুনলাম মধেসীদের হাত থেকে নাকি তিনটে প্রদেশের শাসনভার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে বিরাটনগরও পড়ে। অথচ এই এলাকাগুলো তরাই অঞ্চলে। তাই আলাদা মধেসরাজ্য গঠনের দাবিতে সব মধেসী রাজনৈতিক দল এবং অন্য জনজাতিরা একত্রিত হয়ে এই বনধ্‌ ডেকেছে।
আমরা একদিনের বাংলা বা ভারতবনধ্‌ হলে হাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু নেপালের মানুষজন লাগাতর বনধ্‌-এও যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। দোকান-বাজার সময়-সুযোগ মতো কিছুক্ষণের জন্য খুলে যায়, আবার মিছিল দেখলে বনধ্‌ -এইরকম লুকোচুরিও চলে অনেকসময়। অনেক দোকানদার সামনের শাটার বনধ্‌ রেখেও চুপিচুপি দোকানদারি করে। চাষী বা কাঁচা আনাজের ব্যবসায়ীরা কখনও অসুবিধায় পড়ে আবার কখনও সুযোগমতো দাঁও মারে। সব কিছুই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
বীরগঞ্জে দোকান বা অফিস খুলে রাখার অভিযোগে বনধ্‌ সমর্থকরা ভাঙচুর করেছে। এবারের বনধ্‌-এও  বাস, অটো বনধ্‌। টাঙ্গা কম, কিন্তু রিক্সা, সাইকেল আর মোটরসাইকেল যাতায়াত করছে। আগে এগুলোও নিষেধের তালিকায় আসতে দেখেছি। ব্যবসায়ী সমিতি মিছিল করেছে বনধ্‌ তোলার জন্য। পাল্টা জোরদার মিছিল ছিল বনধ্‌ সমর্থকদের।
২৩ তারিখ কাজের জন্য বীরগঞ্জ থেকে বদ্রীবাস যেতে প্রথমে মোটরসাইকেলে ২০ কিলোমিটার গেলাম। সেখান থেকে সিমেন্টের ট্রাকে গন্তব্যে পৌঁছালাম। সিমরা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে বদ্রীবাস এই ১০৫ কিলোমিটার রাস্তায় ট্রাক ড্রাইভার প্রায় ২০ জনকে লিফট্ দিলেন। অনেকে তাঁকে টাকাপয়সা দিতে গেলেন। নিলেন না। অন্যের বিপদে সাহায্য করার সুবাদে যাঁরা অর্থ বা নাম কামায় সেই সব ‘মহান’ পেশার ‘মহান’ মানুষদের কথা মনে এল। নামবার সময় হাফ প্যান্ট পরা মানুষটিকে মনে মনে শ্রদ্ধা জানালাম।
পশ্চিম নেপালে মধেশিদের মধ্যে ‘থারু’ নামের জনজাতির লোকেরা আলাদা ‘থারুপ্রদেশ’ এর দাবিতে আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। গত ২৫ আগষ্ট সেখানকার ধনগড়ীতে পুলিশকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে খুন করার খবরে নেপাল আরও উত্তপ্ত হয়। এস এস পি পদমর্যাদার একজন সহ নয় জন সাধারণ পুলিশের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। সেখানে অনির্দিষ্টকালের জন্য কার্ফু জারি হয়েছে। এর জেরে অন্যত্র বনধ্‌ আরও জোরদার হয়েছে।
২৬ তারিখ সুমোতে চেপে কাঠমান্ডু গেলাম। পাহাড় যথারীতী সচল থাকলেও অনেককিছুর অভাবে ভুগছে। বেশিরভাগ রসদ ভারত থেকে বীরগঞ্জ বর্ডার হয়ে ঢোকে। আর সেখানেই বনধের প্রকোপ বেশি। তবে শুনলাম বীরগঞ্জ বা জনকপুর থেকে রাতের দিকে বাস কিংবা ট্রাক আসছে। বীরগঞ্জ বর্ডার দিয়ে নেপালে ঢোকার জন্য ভারতের দিকে প্রায় ৩০ কিলোমিটারের মত ট্রাকের লম্বা লাইন পড়েছিল। প্রশাসন তাই এসকর্ট করে ওই গাড়ীকে কাঠমান্ডু বা পাহাড়ের অন্যত্র যাবার ব্যবস্থা করেছে। ওই দিন রাতেই পূর্বগামী রাস্তায় ফুলজোর ও বদ্রীবাসের মাঝে জঙ্গলের রাস্তায় একটা বাস ও একটা ট্রাককে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার খবরে আতঙ্ক বেড়েছে। এছাড়াও বদ্রীবাস থেকে দক্ষিণে গ্রামে পার্কিং করা দুটি বাসেও আগুন ধরানো হয়েছে। মনে করা হচ্ছে পুরোনো শত্রুতা থেকেই এই বাস জ্বলেছে।
বদ্রীবাস এলাকায় পাহাড়ী ও মধেসী সমান সমান। আগে কোনদিন দোকানপাট বনধ্‌ হয়নি। ৩০ তারিখে প্রথম বনধ্‌ হয়েছে। স্থানীয় মধেসী নেতা প্রথমবার বনধের দাবিতে এখানে মিটিং করেছে। মিটিঙের আগে মোটরসাইকেল র‍্যালী হয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের ফ্রীতে তেল দেওয়া হয়েছে। ভরপেট খাওয়ানো হয়েছে। নেতা মানুষটি আর এক সপ্তাহের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন আরও তীব্র হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। চাপা উত্তেজনা ছিল। পুলিস ছিল।  তবে কোনও গন্ডোগোল হয়নি।
৩১ তারিখেও বদ্রীবাসে বন্দী রয়েছি। পাহাড়ের দিকে গাড়ী যাচ্ছে। নীচে নয়। বীরগঞ্জে বনধ্‌ সমর্থকদের বিরুদ্ধে পুলিস গুলি চালিয়েছে।  তিন জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। কার্ফু জারি হয়েছে। কাল কি হবে কেউ জানে না। আর কবে এর অবসান হবে তাও কেউ জানে না।

[সম্পাদকীয় নোট : ২০০৮ সাল থেকে নেপালে নয়া সংবিধান তৈরির প্রয়াস চলছে, কিন্তু কিছুতেই তা করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি নতুন সংবিধানে নেপালকে সাতটি প্রদেশে ভাগ করার কথা বলা হয়েছে। তাকে ঘিরে উত্তপ্ত নেপাল।]