- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

রেট ভালো, তাই কামিন মুনিষ থেকে চাষি, মিস্ত্রি — জঙ্গলমহলের সবাই যাচ্ছে নামালে

অমিত মাহাতো, আঙারকুরিয়া, ঝাড়্গ্রাম, ১৪ মে#

ধানকাটার মেশিন। জঙ্গলমহলের অভিজ্ঞতায়, সস্তা হলেও, মেশিনে কাটার ফলে খড় যেমন নষ্ট হয়, তেমন খড়ের গুঁড়ো লেগে ধান্টাও অপরিষ্কার থাকে। তাছাড়া বোরো বা গরমের ধান একটু কাঁচা কাটতে হয়। কারণ পুরোটা পেকে গেলে ধানটা ঝড়ে পড়ে যায়। কাঁচা ধান কাটার ফলে ধানগুলো ফেটে যায়। এবং কিছু ক্ষেত্রে চালও ভেঙে বেরিয়ে যায়। চাষির কাটা ধানটা ঠিকঠাক পরিষ্কার হয়। চাষির কাটা ধান কুইন্টালে পঞ্চাশ টাকা মতো দাম বেশি চলছে।
ধানকাটার মেশিন। জঙ্গলমহলের অভিজ্ঞতায়, সস্তা হলেও, মেশিনে কাটার ফলে খড় যেমন নষ্ট হয়, তেমন খড়ের গুঁড়ো লেগে ধান্টাও অপরিষ্কার থাকে। তাছাড়া বোরো বা গরমের ধান একটু কাঁচা কাটতে হয়। কারণ পুরোটা পেকে গেলে ধানটা ঝড়ে পড়ে যায়। কাঁচা ধান কাটার ফলে ধানগুলো ফেটে যায়। এবং কিছু ক্ষেত্রে চালও ভেঙে বেরিয়ে যায়। চাষির কাটা ধানটা ঠিকঠাক পরিষ্কার হয়। চাষির কাটা ধান কুইন্টালে পঞ্চাশ টাকা মতো দাম বেশি চলছে।

এই সময়টা শালবনের গ্রামগুলোতে তেমন কাজ নেই। একশ দিনের মাটি কাটার কাজ আপাতত মাস ছয়েক বন্ধ। অবশ্য সে কাজ তো বছরে কুড়ি দিনের বেশি পাওয়া যায় না। বর্ষার জলে একবার মাত্র চাষ হওয়ায় বছরের বাকি দিনগুলো জঙ্গলে শালপাতা সংগ্রহ করে এরা পেট চালায়। এবং সেখান থেকে আসে পঞ্চাশ ষাট টাকা। কথা হচ্ছিল বাঁশতলা স্টেশনে ট্রেনের মধ্যে। সুখদেব মুর্মুর সাথে। বছর চল্লিশ বইয়স। তার বাড়ি বাঁশতলা থেকে উত্তরে ছ কিমি ভেতরের গ্রাম ইরভানপুরে। স্ত্রী ছেলে মেয়ে মিলে পাঁচজনের সংসার। চাষের জমি রয়েছে তিনবিঘার ওপর।
সুখদেব মুর্মু বললেন, ছেলে মাধ্যমিক দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ড্রাইভারি শেখে। এখন অবশ্য বারো চাকা চালায়। মাঝেমধ্যে আসে। মেয়ে নাইনে পড়ে স্থানীয় স্কুলে। জিজ্ঞেস করলাম,
— কবছর ধরে নামালে যাচ্ছ?
— দু-তিন বছর হলো যাচ্ছি লোকের হিড়িক দেখে। আগে বউটা যেত, এখন দু-জনে যাই।
— কতক্ষণ কাজ করতে হয়? সকাল সাতটার মধ্যে জমিতে পৌঁছে যাই। টানা দশটা অবধি খাটি। তারপর গত রাতের রান্না করা ভাত আলুসেদ্ধ দিয়ে খাই। আবার লাগি দেড়টা পর্যন্ত। সে সময় বাবু পয়সা নিয়ে আসেন। এখন হিসেব করে দেখ কঘন্টা হবে।
— মজুরি কত করে দিচ্ছে?
— তা বাবু দুশো টাকা, সাথে মুড়ি।
অর্থাৎ দুশো টাকা করে দুজনের স্বামি স্ত্রী চারশো টাকা। এ কাজ চলবে পনেরো কুড়ি দিন। বেশ কিছু টাকা আসবে। এই আশায় সুখদেব মুর্মুর মতো খাটালি মানুষদের। কিছুটা আর্থিক সুরাহা তো হবেই। বৈশাখের প্রচণ্ড রোদে শরীর পোড়ানো পয়সা। আবার আমাদের মধ্যে কথা হয়। কথা অবশ্য তেমন কিছু নয়। এই যেমন জিজ্ঞেস করলাম,
— এবার (নিজের জমিতে বর্ষার ধানের) ফলন  কেমন হয়েছে?
— ভালো, তবে ধানের দাম ওঠেনি।
— কত চলছে?
— কুইন্টালে হাজার টাকা।
— তবে তো খাটাই সার।
— হ্যাঁ আর জমিন লাঙল মুনিষ দিয়ে চাষ করে তেমন লাভ কিছু নেই। উপায় কি? জমি যখন রয়েছে চাষ ছাড়া করব কি?
হ্যাঁ এ হলো জঙ্গলমহলের কথা। কিন্তু নামালে অর্থাৎ বর্ধমান বা হুগলি নয়, খড়্গপুরের কাছেই কিছুটা পূর্বেই জকপুর মাধপুর বালিচক শ্যামচক প্রভৃতি জমিগুলোয় এখন নামাল। এখানে এত যে চাষ হচ্ছে, এই গরমের সময়টাতে জল কীভাবে আসে? আগে অবশ্য দুজনে মিলে দোজ্ঞার ব্যবহারে সেচ দিত। এখন অবশ্য দোগগার চল তেমন নেই। কারেন্টের সাহায্যে জল তোলা, মিনি, পাম্প এসবের সাহায্যে। কোনো জমিই এমনি পড়ে নেই। চাষ বেড়েছে। ফলনও ভালো। তাই নামালে সুলভ কৃষি শ্রমিকের অভাব পুষিয়ে দিতেই ভিড় বাড়াচ্ছে জঙ্গলমহল। শ্যামচক বালিচক মাধপুর জকপুর প্রভৃতি স্টেশনের ডাইনে বাঁয়ে, হাজারো কামিন মুনিষের কাজ করা মানুষ থেকে জঙ্গলমহলের সম্পন্ন চাষি — সবাই নামালের পথে পা বাড়িয়েছে। এবং কিছুদিনের জন্য কাজের লোকে রূপান্তরিত হচ্ছে।
রাত্রিবেলা কথা হয় আমার গ্রাম আঙারকুরিয়ার কার্ত্তিক হাঁসদার সাথে। সে ও তার স্ত্রী দুজনে মিলে নামালে দশ দিনের ওপর কাজ হয়ে গিয়েছে তাদের। কার্ত্তিক আমার পাড়া সম্পর্কে কাকু। ও এমনিতে ঝাড়গ্রাম শহরে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করে। এখানে লেবার রেট একশ সত্তর টাকা। মিস্ত্রিদের অবশ্য একটু বেশি ২৮০ টাকা। নামালে ধান কাটা বাবদ ২০০ টাকা মজুরি হওয়ায় জোগাড়ের কাজ ফেলে দিয়ে ও এখন নামালের কাজে যাচ্ছে। তিরিশ টাকা বেশি পয়াবে বলে কথা নয়। ওখানে গেলে স্বামী স্ত্রী দুজনেই একসাথে কাজ করতে পারবে। এই আশায় নামালে যাওয়া। কাকীমা বললেন, চ্ছ্রওখানে কাজের লোক দিয়ে কাটা হচ্ছে, অন্য দিকে ধানকাটা মেশিন দিয়েও হচ্ছে। অবশ্য মেশিনে কাটা ধানের দাম কম। অবশ্য চাষি মেশিন ধান কাটানোর ফলে তার খরচও কম পড়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ মিছিলের মতো দল বেঁধে কাজ করতে যাচ্ছে।’