- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

রাজ্যপালের কাছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের স্মারকলিপির বয়ান

ছবিটি মীনাক্ষি সরকারের তোলা।
২০ সেপ্টেম্বর ছাত্রছাত্রীমিছিলের ছবিটি মীনাক্ষি সরকারের তোলা।

মূল ইংরেজি বয়ান এখানে। অনুবাদ শমীক সরকার#

প্রতি
হিজ এক্সেলেন্সি

শ্রী কেশরিনাথ ত্রিপাঠি

আমরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ১৭ সেপ্টেম্বর ভোর আড়াইটের সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশি নির্যাতন এবং তাদের গ্রেপ্তারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে এই চিঠি লিখছি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শান্তিপূর্ণভাবে একটি ধর্না চালাচ্ছিলেন ২৮ আগস্ট রাতে ঘটে যাওয়া একটি সাঙ্ঘাতিক যৌননিগ্রহ এবং মারধোরের ঘটনার প্রতিবাদে। ঘটনাক্রম একটি সংযোজনীতে বিবৃত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক সংস্থা এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের একটি সভা ছিল ১৬ সেপ্টেম্বর। দুর্ভাগ্যবশত, সেই বৈঠকে এই মারাত্মক ঘটনা বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি এবং ছাত্রদের কোনো নিশ্চয়তাই দেওয়া হয়নি, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, একজন মনোবিদ, একজন লিঙ্গঅধিকার কর্মী, একজন মহিলা কমিশন সদস্য, এবং একজন মানবাধিকার কমিশন সদস্যের অন্তর্ভুক্তি করে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গড়া হবে কিনা সে বিষয়ে। কর্তৃপক্ষের তরফে বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীন অভিযোগ গ্রহণ কেন্দ্রের দুই সদস্যকে, যারা নিগৃহিতার ওপর মানসিক চাপ দিয়েছিল এবং তদন্তকে সেভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল, তাদের অপসারনের দাবিরও কোনো জবাব দেওয়া হয়নি। তাই ওই দিন (১৬ সেপ্টেম্বর) ছাত্রছাত্রীরা ঠিক করে, ১০ সেপ্টেম্বর থেকে লাগাতার যে ছাত্র ধর্না চলছিল সেটা তারা চালিয়ে যাবে যতক্ষণ না এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল এবং উপাচার্য এই ব্যাপারে কোনো বার্তা দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সমস্ত চেষ্টা বিফল হয়। ভোররাত আড়াইটের সময় বিশাল সংখ্যক পুলিশ এবং অপরিচিত ব্যক্তিরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢোকে এবং তারা নিষ্ঠুরভাবে মারধোর করে নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের। ছাত্রীদের ওপর হামলা চালায় পুরুষ পুলিশ অফিসার এবং অপরিচিত ব্যক্তিরা। মহিলা প্রতিবাদীদের চুল ধরে টানা হয়, তাদের জামাকাপড় ছিঁড়ে দেওয়া হয়। প্রচুর ছাত্রছাত্রী মারাত্মকভাবে আহত হয়ে নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি হয়। সাঁইত্রিশ জন ছাত্রছাত্রীকে লালবাজারে নিয়ে যায় পুলিশ।
আমরা নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের ওপর, যারা একসপ্তাহ ধরে একটি শান্তিপূর্ণ ধর্না সংগঠিত করছিল, তাদের ওপর পুলিশের এই নিষ্ঠুর হামলার তীব্র নিন্দা করছি। আমরা ছাত্র হিসেবে আরো মনে করছি, যিনি ছাত্রছাত্রীদের ওপর এই চরম হিংসাত্মক হামলা নামিয়ে দিলেন (এবং তার আগে ও পরে যিনি ছাত্রছাত্রীদের বক্তব্যকে কোনো পাত্তাই দিলেন না), সেই উপাচার্যের আর কোনো নৈতিক অধিকার নেই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নেতৃত্ব দেওয়ার। আমরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তীব্রভাবে মনে করছি, উপাচার্যের এই চরম নিন্দনীয় কাজ এবং শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় অনীহার দায়ভার কাঁধে নিয়ে এখনি পদত্যাগ করা উচিত।
এছাড়াও, আমরা বিশ্বাস করি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে পর্যাপ্ত ছাত্রছাত্রী প্রতিনিধি থাকা দরকার। একমাত্র এভাবেই ছাত্রছাত্রী এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যের বিশ্বাসের সম্পর্ক ভেঙে পড়া আটকানো যায়।
মহাশয়, আমরা বিনীতভাবে আপনার কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে আপনি অবিলম্বে পদক্ষেপ করুন এই জরুরি বিষয়টিতে। আমরা আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি মূল ঘটনায় এবং তারপর প্রতিবাদের সময় নিগৃহিত ছাত্রছাত্রীদের প্রতি ন্যায়বিচার করুন।

সংযোজনী

২৮ আগস্ট থেকে ১২ সেপ্টেম্বর অবধি ঘটনাক্রম

২৮ আগস্ট রাত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি চলার সময় ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী ক্যাম্পাসের মধ্যেই নিগৃহিতা হয় একদল লোকের হাতে, তার এক বন্ধু (সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়) মার খায়। ছাত্রীটির বয়ান অনুযায়ী সে তার ওই বন্ধুর সঙ্গে হোস্টেলের কাছে টয়লেট করতে গিয়েছিল, কারণ রাত্রিবেলা কোনো শৌচাগার খোলা থাকে না। ফিরে আসার সময় একদল ছেলে তাদের টিটকিরি দিতে থাকে বলে অভিযোগ এবং ঘটনাটি মারপিটে গড়ায়। মেয়েটির বন্ধুটিকে টেনে নিয়ে গিয়ে মারধোর করা হয় এবং মেয়েটিকে হস্টেলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাকে যৌননিগ্রহ করা হয়েছে বলে মেয়েটি দাবি করে।
মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে পরদিনই। উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করলে উপাচার্য মেয়েটিকে পনেরো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে বারণ করেন এবং কী কারণে তা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তার কারণে’। যখন তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে তাঁরই তো নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, তিনি বলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কড়া নজরদারি চালু করলে ছাত্রছাত্রীরাই তার প্রতিবাদ করবে। নিগৃহিতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে একটি অ্যান্টি-সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেল রয়েছে, যা কিনা উপাচার্যেরই অধীনে কাজ করে না, একটি স্বয়ংক্রিয় সংস্থা, তার কথা জানানো হয়নি। এই ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়ে মেয়েটি যাদবপুর থানায় ১ সেপ্টেম্বর একটি এফআইআর করে।
৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা একটি সাধারণ সভা করে, এবং সেখান থেকে ডিন-কে লেখা একটি স্মারকলিপি চূড়ান্ত করা হয়। এই স্মারকলিপিতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করার দাবি জানানো হয় ঘটনার তদন্ত করার জন্য, যার মধ্যে থাকবে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, একজন মনোবিদ, একজন লিঙ্গ অধিকার কর্মী, মহিলা কমিশনের এক সদস্য, মানবাধিকার কমিশনের এক সদস্য। আরো দাবি করা হয়, তদন্ত শেষ করতে হবে সাত দিনের মধ্যে, এবং তদন্ত কেমন চলছে সে বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের জানাতে হবে।
যে এফআইআর-টি করা হয়েছিল, তাদের নিগৃহিতা একজন নিগ্রহকারীকে চিহ্নিত করেছিলেন। ভারতীয় পেনাল কোডে এই চিহ্নিতকরণের ওপর দাঁড়িয়েই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারত। তার বয়ান নেওয়ার জন্য তাকে ডাকতে পারত। কিন্তু উপাচার্য অনুমতি দিয়েছেন, তবু পুলিশ কিছু করছে না, এমন মনে হওয়াতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যাদবপুর থানায় একটি মিছিল করে যায় ৫ সেপ্টেম্বর। পুলিশ ছাত্র প্রতিনিধিদের জানায়, তাদের আরো কিছু সময় লাগবে। ওই একই দিনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দুইজন প্রতিনিধি নিগৃহিতার সঙ্গে দেখা করে। তারা তাদের পরিচয় না জানিয়ে নিগৃহিতা ওই ২৮ আগস্ট কী জামাকাপড় পড়ে ছিল, কী অবস্থায় ছিল এসব জিজ্ঞেস করে। আইন মাফিক তদন্তের সময় অভিযুক্ত বা অভিযোগকারী কোনো পক্ষকেই এইভাবে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে চাপ দেওয়া যায় না। নিগৃহিতা চরম মানসিক চাপের শিকার হয়ে বিধাননগর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করে। ৮ সেপ্টেম্বর অল ইন্ডিয়া প্রোগ্রেসিভ ওম্যান্স অ্যাসোসিয়েশনের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সভার কয়েকজন ছাত্রছাত্রী উপাচার্যের কাছে একটি অভিযোগ জমা দিতে যায়। উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে সহ-উপাচার্য অভিযোগ নেন। তিনি একটাই কথা কেবল বলেন, ‘আমি কিছু জানি না’।
ওই ৮ সেপ্টেম্বর-ই ছাত্রছাত্রীরা উপাচার্যের অফিসে একটি মিছিল করে যায় এবং তার কাছে নিগৃহিতাকে দোষ দেওয়ার কেন চেষ্টা হচ্ছে তা জানতে চায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীন অভিযোগ গ্রহণ কেন্দ্রের সদস্যরা কোনো পাবলিক বিবৃতি দিতে অস্বীকার করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিভাগের সাধারণ সম্পাদক এবং ওই কেন্দ্রের ছাত্র প্রতিনিধি কেন্দ্রটির পক্ষপাতদুষ্ট তদন্তের প্রতিবাদে ওই কেন্দ্রের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। সবাই মিলে দাবি করা হয়, ওই কেন্দ্রের কাছ থেকে একটি পাবলিক বিবৃতি। কিন্তু তা না দিয়ে ওই কেন্দ্রের সদস্যরা চলে যেতে গেলে ছাত্রছাত্রীরা তাদের বাধা দেয়, তখন ওই কেন্দ্রের সদস্যদের সাথে সাথে থাকা পুরুষরা হিংস্রভাবে ছাত্রছাত্রীদের আটকায়। পরে যখন ওই কেন্দ্রের তিন সদস্যের সঙ্গে ছাত্র প্রতিনিধিরা দেখা করার সুযোগ পায়, কেন্দ্রের সদস্যরা নিগৃহিতাকে দোষ দিয়ে কোনোরকম কিছু তারা করছে না বলে জানায় এবং বলে, মিডিয়ার কাছে রঙ চড়িয়ে এসব কথা না বলতে।
৯ সেপ্টেম্বর ঘটনাচক্রে ‘এই সময়’ নামে একটি বাংলা দৈনিকে একটি রিপোর্ট বেরোয় এবং তাতে ওই কেন্দ্রের এক সদস্য দাবি করেন, তিনি ছাত্রছাত্রীদের হাতে নিগৃহিতা হয়েছেন। কাগজে লেখা ছিল, তিনি বলেছেন, ‘আমাকে লাথি মারা হয়েছে, ঠেলা হয়েছে, জাপটে ধরা হয়েছে।’ যদিও ছাত্রীরা একটি হাতে হাত রেখে ব্যারিকেড রচনা করেছিল তিনি যাতে না পালাতে পারেন তার জন্য। ওই দিনই একটি সাধারণ সভা হয়, ছাত্রছাত্রীরা সেখানে একটি খোলা চিঠি লেখে ওই সদস্যের উদ্দেশ্যে এবং দাবি করা হয় তার অভিযোগের সমর্থনে সিসিটিভি ফুটেজ জমা দেওয়ার জন্য, কারণ ওই দিনের অবস্থানের পুরো সময়টা ছাত্রছাত্রীরা সিসিটিভি-র তলায় ছিল।
১০ সেপ্টেম্বর আর একটি সাধারণ সভা হয় ছাত্রছাত্রীদের এবং সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ছাত্রছাত্রীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্নায় বসবে অরবিন্দ ভবনের (মূল প্রশাসনিক ভবন) সামনে, যতক্ষণ না একটি পাবলিক বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। উপাচার্য নীরব থাকেন এবং পরোয়া করেন না বুঝিয়ে দেন। ওইদিন সন্ধ্যেবেলায় আরেকটি সাধারণ সভায় ছাত্রছাত্রীরা ঠিক করে, তারা পরদিন অধ্যক্ষের অফিসে যাবে ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি নিয়ে, এবং ১২ সেপ্টেম্বর একটি আপতকালীন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল মিটিং ডেকে উপাচার্য যাতে একটি নতুন তদন্ত কমিটি স্থাপন করেন তার দাবি করবে, কারণ অভিযোগগ্রহণ কেন্দ্রটি এরই মধ্যে তার অদক্ষতা এবং আইন কানুন না মেনে অপরাধমূলক কাজকর্ম করার প্রমাণ দিয়ে ফেলেছে। ওইদিন সন্ধ্যেতেই একটি কথোপকথনে উপাচার্য কয়েকজন ছাত্রপ্রতিনিধিকে বলেন, তিনি পুলিশ ডাকতেই পারেন এভাবে চললে এবং তিনি যেটা করতে পারেন, ছাত্রছাত্রীদের দাবি ১৬ তারিখের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল মিটিং-এ তুলতে পারেন। যদি তাই হয়, তাহলে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে এটি জিরো হাওয়ারে উঠবে, তাই জন্য ছাত্রছাত্রীরা সঙ্গে সঙ্গে একটি ডেপুটেশনের ড্রাফট তৈরি করে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল মিটিং যাতে করা হয় তার জন্য। ধর্না দিনরাতভর চলতে থাকে, যদিও এরমধ্যে পুলিশ এসে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে। কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের ডেপুটেশনে সাড়া দেয় না এবং ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখেই এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল মিটিং ঘোষিত হয়। সেদিন কী ঘটেছিল তার কিছুটা বর্ণনা চিঠির মূল বয়ানে রয়েছে।