- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

রাজ্যপালের কাছে খোলা চিঠি

মেটিয়াব্রুজের রাস্তায় দুষ্কৃতীর গুলিতে পুলিশ-কর্মীর মৃত্যুতে আমরা সকলেই ব্যথিত। খবরের কাগজে পড়লাম, আপনি বলেছেন, ‘আমি বরাবরই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের রাজনীতিকরণ এবং ক্যাম্পাসে হিংসার বিরুদ্ধে’ কথাটাতে খটকা লাগে। আপনি নিশ্চয় অন্যত্র, যেমন জঙ্গল বা গ্রামেও হিংসার বিরুদ্ধে? হিংসা তো সর্বত্র নিন্দনীয়। একইদিনে আসামের গ্রামে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বারোজন পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। সেটা কি নিন্দনীয় নয়? আপনি বলছেন, স্কুল-কলেজে রাজনীতি নয়। মিডিয়াতে অনেক নেতাই একই কথা বলছেন। খোদ মিডিয়ার কর্তারাও এই সুরে তাল দিচ্ছে। ব্যাপারটা কী? ছাত্রছাত্রীরা ইউনিয়ন করবে, বিধানসভা-লোকসভা-পঞ্চায়েতে নেতা নির্বাচন করবে, অথচ রাজনীতি করবে না, এ কেমন কথা? কেন ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের বোধবুদ্ধি প্রয়োগ করে রাজনীতির ভালোমন্দ বুঝতে চাইবে না? তাদের কি বিচারবোধ বলে কিছু নেই? যত বিচারবোধ কি অভিভাবকদেরই আছে?
আসলে মেটিয়াব্রুজের ঘটনাটা যদি আপনি একটু ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখতেন, তাহলে এমন মন্তব্য বোধহয় করতে পারতেন না। হরিমোহন ঘোষ কলেজের ইউনিয়ন নির্বাচনের নমিনেশন ফর্ম তোলাকে কেন্দ্র করে গণ্ডগোল, মারামারি। অথচ ঘটনাস্থলে কলেজের ছাত্রছাত্রী কেউই ছিল না। আগের দিন রাতে বোমা বাঁধতে গিয়ে যারা আহত হয়েছে, তারাও ওই কলেজে কেউ পড়ে না। তাহলে এই সন্ত্রাসের সঙ্গে ওই কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কতটুকু সম্পর্ক? কলেজের ছাত্র রাজনীতি যদি ছাত্ররাই করত, তাদের ওপর দাদারা যদি ছড়ি না ঘোরাত, তাহলে এসব কিছুই ঘটত না। এটা শ্রমিক-কৃষক-আদিবাসী, গ্রাম-শহর-জঙ্গল বা ফ্যাকট্রি-অফিস-কলেজ সমস্ত ক্ষেত্রেই সমান প্রযোজ্য। যার কাজ তাকে করতে দাও। দাদাগিরি বন্ধ করো।
হিংসার নিন্দার ক্ষেত্রে আপনারা কিছু শর্ত আরোপ করতে চান। একবার সরাসরি আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমরা কয়েকজন জঙ্গলমহল এবং অন্যত্র হিংসা বন্ধ করার জন্য একটা আবেদন নিয়ে আপনার কাছে গিয়েছিলাম। আমরা যখন রাষ্ট্রীয় হিংসা বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললাম, আপনি বলেছিলেন, আগে মাওবাদীরা হিংসা বন্ধ করুক। আমরা বলেছিলাম, মাওবাদীদের আমরা স্পষ্টভাবেই হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করতে বলেছি। কিন্তু আমরা সেই দলের কেউ নই। রাষ্ট্রের কাছে যখন আসছি, আমরা তার সদস্য-নাগরিক হিসেবে আসছি, তাই মাওবাদীদের চেয়ে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে আপনার কাছে আমাদের বলার হকটা বেশি। কে আগে আর কে পরে বন্ধ করবে, এইভাবে নিলে সংগঠিত হিংসা চক্রাকারে চলতেই থাকে। আর তার বলি হয় সাধারণ নাগরিক।
মেটিয়াব্রুজেও সেটাই হল। ভাবুন, একজন সাধারণ পুলিশ-কর্মী মারা যাওয়ার পরেও কংগ্রেসের সমর্থকেরা মেটিয়াব্রুজ থানার সামনে অবরোধ করেছে। তখনও তাদের মধ্যে ঘটনাটার জন্য কোনো দুঃখবোধ নেই। আর তৃণমূলের মন্ত্রীরা গিয়ে সদ্য মৃত পুলিশ-কর্মীর পরিবারকে চাকরি আর অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কতখানি নির্দয় তাঁরা হতে পারেন! একইভাবে দেখেছিলাম, দিল্লির ধর্ষিতা ছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে সোনিয়া গান্ধী চাকরি আর অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মানুষকে এঁরা কী ভাবেন? এটাও তো এক ধরনের হিংসা।
আচ্ছা, আপনি তো মেটিয়াব্রুজের ঘটনাটা জানার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের পালক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীকে মৃত পুলিশ-কর্মীর বাড়িতে গিয়ে ওঁর স্ত্রীকে সমবেদনা জানানোর জন্য অনুরোধ করতে পারতেন। সেলিব্রিটিদের কাছ থেকে মিডিয়ার এইসব বিবৃতি সংগ্রহ এবং দ্বি-দলীয় সংঘাত বাড়িয়ে তোলার জন্য মঞ্চ সাজিয়ে দেওয়া কি হিংসার বাতাবরণকেই বাড়িয়ে তুলছে না?