- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ও উন্নয়ন ভাবনা — আলোচনাসভা

তমাল ভৌমিক, কলকাতা, ২০ এপ্রিল#

pNandiniSPD7_pic

১৯ এপ্রিল ২০১৪, ভ্রাম্যমান রবীন্দ্র জন্মোৎসব কমিটি ও নান্দীমুখ সংস্কৃতি কেন্দ্র — এই দুই সংস্থার পক্ষ থেকে শহিদনগর, গাঙ্গুলিপুকুরে এক আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছিল — বিষয় রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ও উন্নয়ন ভাবনা। সভার শুরুতে মিহির চক্রবর্তী আয়োজক সংগঠনগুলোর পরিচয় এবং বক্তা ও সঞ্চালকের পরিচয় করিয়ে দেন সভার দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে। সঞ্চালক ছিলেন সুজয় বসু, প্রধান বক্তা সমর বাগচী। সঞ্চালকের আহ্বানে প্রথমে বক্তব্য রাখেন সমর বাগচী।   রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখা — ১৯৩০ সালে শান্তিনিকেতনে গ্রামবাসীদের প্রতি বক্তৃতা, ১৯৩২-এ রানী মহালনবীশকে লেখা চিঠি, বিলাসের ফাঁস ও সভ্যতার সংকট নামক বিভিন্ন প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি তুলে শ্রী বাগচী দেখান যে রবীন্দ্রনাথ নবসভ্যতার বিচ্ছিন্নতাকে ধরতে পেরেছিলেন এবং পশ্চিমের দেশগুলোর নানা আয়োজন যে গভীর অশান্তি ডেকে আনছে সে সম্পর্কে চেতাবনী দিয়েছিলেন। নগর ও গ্রামের জীবনের প্রতিতুলনায় তিনি বলেছিলেন, সামাজিকতা নগরে জমাট বাঁধতে পারে না, কারণ নগর আয়তনে ও জনসংখ্যায় বড়ো। পাশাপাশি ব্যক্তিগত বিলাস বেড়ে যাওয়া, ধনীতে ধনীতে প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে ভোগবাদের বৃদ্ধির সমালোচনাও করেছিলেন। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ নিজে শান্তিনিকেতনের গ্রামে কাজ করেছেন, শ্রীনিকেতন গড়েছেন — যার মধ্যে দিয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ খুঁজেছেন। একদিকে তিনি এই আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার জন্য স্বায়ত্তশাসন ও নিজ-পাঠশালা ও নিজ-শিল্পশালা গড়ে তুলতে বলেছেন সমবায় নিয়ে বলতে গিয়ে (১৯২৮) তারও আগে বলেছেন, ণ্ণস্বদেশি সমাজ’-এ ণ্ণআত্মশক্তি’র কথা ও ণ্ণস্বাবলম্বী’ হওয়ার কথা এবং অন্যদিকে তিনি ণ্ণমুক্তধারা’ নাটকে বাঁধ ভেঙে দিয়ে বা ণ্ণরক্তকরবী’-তে শিল্পসভ্যতার সমালোচনা করে চালু উন্নয়নের বাইরে এক অন্যরকম বিকাশের কথা বলতে চেয়েছেন।
এইসব রাবীন্দ্রিক ভাবনার পাশাপাশি সমর বাগচী বর্তমান দুনিয়ার অবস্থার কথাও বলেন — ভোগবাদের বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন, ণ্ণ১৮০০ সালে আমেরিকার কোনো বাজারে কোনো ক্রেতা গিয়ে ৩০০ রকম জিনিস কিনতে পারত, আর এখন ১০ লক্ষ রকম জিনিস কিনতে পারে। আজকের কলকাতা শহরেও এরকমই ছবি দেখতে পাই আমি।’ আরও বলেন, ১৯৮৯ সালে আমেরিকার এক সম্মেলনে গিয়ে তিনি আমেরিকান বিজ্ঞানীর মুখে শুনেছেন, আমেরিকা সবরকম কারিগরি প্রয়োগ করে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে এনে ফেলেছে, তখনই ৬ কোটি মানুষ সেখানে নিরক্ষর, ৪০ বছরের ব্যবধানে হিংসা বেড়েছে ১১০০০ শতাংশ এবং ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ৩:১ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০০:১। শ্রী বাগচী জানান, বাস্তুতান্ত্রিক পায়ের ছাপ (ইকোলজিক্যাল ফুট প্রিন্ট) বলে একটা ব্যাপার আছে, যা জনপ্রতি হিসেবে করলে পৃথিবী ১.৯ হেক্টর পর্যন্ত ধারণ করতে পারে। কিন্তু গত ৭/৮ বছরে তা ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে এবং এর জন্য ধনীদের ভোগবাদই দায়ী। গরিবরা প্রকৃতি থেকে খুব কমই নেয় — পরিসংখ্যানে তাই দেখা যায়, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ওই বাস্তুতান্ত্রিক পায়ের ছাপ যেখানে জনপ্রতি ১০ হেক্টর, তৃতীয় দুনিয়ার দেশে সেখানে জনপ্রতি ১.৪ থেকে ১.৫ হেক্টর।
বক্তব্যের শেষ অংশে শ্রী বাগচী জানান, আমাদের পরিবেশ কেমন খারাপ হয়ে আসছে — উষ্ণতা বৃদ্ধি, মেরু প্রদেশের বরফ গলে যাওয়া ও তার জন্য গ্রীন হাউস গ্যাসের বৃদ্ধি; সমুদ্রের জলে তেল মিশে যাওয়া, পারমাণবিক জ্বালানি ও অন্যান্য দূষণের ফলে প্রতিদিন ১০ থেকে ১০০ প্রজাতির জীব ধ্বংস হয়ে যাওয়া — এসবের কথা বলার শেষে তিনি বলেন যে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য প্রকৃতির সাথে আমাদের সাম্য, আগের প্রজন্মের সাথে পরের প্রজন্মের সাম্য ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তুলতে পথে নামতে হবে। সাথে সাথে তিনি জানান, এরকম কাজ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে তিনি দেখেছেন, যেমন রাজস্থানে, বা উড়িষ্যার দেবল দেব বীজ নিয়ে এমন কাজ করছেন।

এরপরে বক্তব্য রাখেন শুভেন্দু দাশগুপ্ত। শ্রী দাশগুপ্ত জানান, নান্দীমুখের সদস্য তাঁদের অনেক দিনের বন্ধু খোকনদার মৃত্যু এর আগের দিনই হওয়ায় তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে পারেননি বক্তব্য বিষয়ে। তবু যা বলবেন, তা খোকনদাকেই উৎসর্গ করে। তিনি বলেন, সমবায় নীতির ৪টি প্রবন্ধই আলোচ্য এবং এই প্রবন্ধগুলোয় রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন, তাতে দেখা যায় বার বার নিজেকে প্রশ্ন করে রবীন্দ্রনাথ নিজের মত বদলেছেন। রবীন্দ্রনাথের গোটা জীবনেই এরকম মত বদলানো দেখা যায় — যা বড়ো দার্শনিকের লক্ষণ।   ওই চারটি প্রবন্ধের প্রথম প্রবন্ধে উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে যে কৃষি সমবায়ের কথা বলা হয়েছে, তা আজকের ল্যান্ড রিফর্ম অ্যাক্টের সদৃশ।   রবীন্দ্রনাথ টুকরোর বদলে একযোগ হয়ে থাকার যে কথা বলেছেন, সে যেন পুঁজিবাদী অ্যালিয়েনেশনের বদলে সমাজতান্ত্রিক সম্মিলনের কথা। পরে তিনি হাতিয়ার উন্নয়নের কথা বলছেন, যা আবার পুঁজিবাদী ক্ষমতার জন্ম দেয় — সেটা রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন না তা নয়, যন্ত্রপ্রয়োগ করার কথা বলেছেন সমবায়ের মধ্যে দিয়ে; দরিদ্রের সমস্যাকে কল্যাণ দিয়ে ঠেকানোর কথা বলছেন — এমনকী কল্যাণকে স্বার্থের অনুবর্তী করা হয়েছে, কেন অগ্রবর্তী করা হয়নি এমন সমালোচনাও তুলেছেন — যা আজকের কল্যাণকামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আলোচনায় আমরা করি।  সর্বপ্রকার প্রয়োজন সাধনক্ষম গ্রামের যে ধারণা তাঁর, তার সঙ্গে আমাদের খাদ্য-সার্বভৌম গ্রামের আজকের ধারণা মেলে।   ১৯২৭ এ তিনি বলেছেন, ণ্ণঐক্যবোধের দ্বারাই সকলপ্রকার ঐশ্বর্যের সৃষ্টি হয়। … রাষ্ট্রিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় ইউরোপ সেই ঐক্যকে অস্বীকার করছে।’ কোনো সময়ে তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে উপরে রাখছেন আবার রাখছেন না, বলছেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অসাম্য তৈরি করছে।   যন্ত্রের কাছে স্বাভাবিক শক্তির হার আটকানো যায় যদি সবাই এক হয় — ধনের স্রোতটা যদি সকলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় — এরকমই রবীন্দ্রনাথের মত। এই সবের সঙ্গেই আমরা একমত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতে ধনীকে মেরে তা হয় না, আর আমাদের মতো পুরনো নকশাল ভাবধারার লোকরা মনে করি, ধনীকে না মেরে ধনের মুক্তি হয় না।
এরপরে অনুপ দত্ত তাঁর বক্তব্যে জানান, রবীন্দ্রনাথ সুন্দরের পূজারী হওয়ায় সমাজের অনেক অসুন্দর দিক, সাধারণ মানুষের দুর্দশা কবির নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যে সাড়ে ছ-টা থেকে সাড়ে আটটা এই সভায় মোট ৪০-৪২ জন উপস্থিত ছিল। সভার শেষে ব্যক্তিগত স্তরে বিকল্প জীবনযাপনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব রাখেন মিহির চক্রবর্তী।