- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

মারুতি সুজুকি মানেসর ডায়েরি (২)

টানা তেরো দিন কারখানা শ্রমিকদের দখলে

শের সিং সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ‘ফরিদাবাদ মজদুর সমাচার’ থেকে#

দিল্লি, নয়ডা, গুরগাঁও, ফরিদাবাদ শিল্পাঞ্চলে যে শ্রমিকেরা কাজ করে, তাদের ৭০-৭৫ শতাংশ কোম্পানি বা সরকারের নথিভুক্ত নয়। স্থায়ী শ্রমিকদের পাশাপাশি রয়েছে অস্থায়ী শ্রমিকেরা। অস্থায়ীদের মধ্যে রয়েছে ক্যাজুয়াল এবং ঠিকা শ্রমিক। ঠিকেদাররা সকলে রেজিস্টার্ড নয়। শ্রমিকদের মধ্যে সকলে ইএসআই এবং পিএফ পায় না। ফ্যাকট্রিগুলিতে কর্মরত শ্রমিকদের ৭৫-৮০ শতাংশ সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম বেতন পায় না। ফ্যাকট্রিতে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা ডিউটি এক সাধারণ চিত্র। ৯৫-৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে ওভারটাইম করলে দ্বিগুণ বেতন পাওয়া যায় না।
এইরকম পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা কারখানায় কারখানায় ম্যানেজমেন্টের জুলুমের প্রতিবাদে কাজ বন্ধ করে দিয়ে বসে পড়ত। রিকো অটো, ডেন্সো, ভিভা গ্লোবাল, হরসূর্য হেল্‌থকেয়ার, সেন্ডেন বিকাশ ফ্যাকট্রিতে প্রতিবাদী শ্রমিকদের কারখানার গেটের বাইরে বের করে দিতে ম্যানেজমেন্ট সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু হন্ডা ও হিরো হন্ডা-তে ঠিকা শ্রমিকদের কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়ার পর তাদের গেটের বাইরে আনতে কোম্পানি ও সরকারের ঘাম বেরিয়ে যায়। মারুতি সুজুকির মানেসর ফ্যাকট্রির ভিতর ঘটনা অন্য রূপ নিল।
৪ জুন ২০১১ মানেসর ফ্যাকট্রির ভিতর এ-শিফটের শ্রমিকদের সঙ্গে ম্যানেজমেন্টের বচসা হয়। দুপুর তিনটে কুড়ি নাগাদ শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে দেয়। ইতিমধ্যে বি-শিফটের শ্রমিকেরাও কারখানার ভিতর এসে জড়ো হয়েছে। ফোন করে সি-শিফটের শ্রমিকদের ফ্যাকট্রির ভিতর ডেকে আনা হয়। তিন শিফটের স্থায়ী শ্রমিক, ট্রেনি, অ্যাপ্রেন্টিস ও ঠিকা শ্রমিক মিলে আড়াই-তিন হাজার শ্রমিক কারখানার ভিতর জমা হয়। মানেসর কারখানা শ্রমিকদের দখলে চলে যায়।
শ্রমিকদের আচমকা এই পদক্ষেপে ম্যানেজমেন্ট হতবাক হয়ে যায়। হরিয়ানা সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার অসহায়! রাত ভোর হয়। কারখানা দখল করে শ্রমিকদের এই অভিনব হরতাল চলতে থাকে। শ্রমিকদের কারখানার বাইরে আনার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। সমস্ত শ্রমিক-বিরোধী পক্ষ হায় হায় করতে থাকে। কারখানা দখলের তৃতীয় দিন ৬ জুন কোম্পানি বেছে বেছে ১১ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করে।
দিনের পর দিন কাজের বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে সকলে একসঙ্গে কাটানো — এমন দিন স্বপ্নেও শ্রমিকদের জীবনে আসেনি। প্রত্যেকে নিজের মতো করে এই অবসরকে উপভোগ করে। ব্যক্তিগত একান্ত গল্প, আড্ডা, হৈচৈ, গান, নাচ — কী হয়নি এই দিনগুলিতে! শ্রমিকেরা অনেকেই বয়সে যুবক, তারা যেন পাখা মেলে উড়ছিল।
ইতিমধ্যে কোম্পানির সঙ্গে শ্রমিকদের কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। একটা আপোষ-মীমাংসার চেষ্টা উভয় তরফেই দেখা গেল। অবশেষে গুরগাঁও সার্কেল দুইয়ের অ্যাসিস্টান্ট কমিশনার জে পি মানের মধ্যস্থতায় ১৬ জুন একটা চুক্তি হয়। তাতে ১১ জন ছাঁটাই শ্রমিককে কাজে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এর আগে শ্রমিকেরা কাজে অনুপস্থিত থাকলে প্রতিদিনের জন্য জরিমানা স্বরূপ তিনদিনের মাইনে কেটে নেওয়া হত। এই চুক্তিতে ঠিক হল, প্রতিদিন অনুপস্থিতির জন্য একদিনেরই মাইনে কাটা যাবে। ১৮ জুন শ্রমিকেরা ফের কাজ শুরু করল। সবচেয়ে বড়ো কথা, ১৩ দিন শ্রমিকদের দখলে থাকার পর ফ্যাকট্রির ভিতর সুপারভাইজর এবং ম্যানেজারদের রোয়াব আর তুইতোকারি সাময়িকভাবে বন্ধ হল।
জুন ২০১১-র আগে মানেসর ফ্যাকট্রিতে এ-শিফট শুরু হত সকাল ৭টার জায়গায় ৬টায় আর বি-শিফটে রাত সাড়ে বারোটার জায়গায় ১টা ৪০ মিনিটে ছুটি হত। প্রতিদিন এই দু-ঘণ্টার ওভারটাইম ম্যানেজমেন্ট হিসেবে দেখাত না এবং ডাবলের বদলে সিঙ্গল রেটে শ্রমিকদের পেমেন্ট করত। তেরো দিনের দখল আন্দোলনের পর এই ওভারটাইম বন্ধ হয়ে গেল।
চলবে