- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘মাটিতে পা থাকে কি না শূন্যেতে রও ভাসিয়া, সব জানতে পারবে সিয়ার কাছে, সিয়া সিয়া সিয়া’

শমীক সরকার, ১০ জুন#

মাইক্রোসফট, গুগল, ইয়াহু, ফেসবুক, অ্যাপল, ইউটিউব, এওএল, স্কাইপ এবং পালটক এই নামগুলি সবাই আমরা জানি ইন্টারনেটের তথা কম্পিউটার দুনিয়ার দানবীয় কর্পোরেশন হিসেবে। সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এদের ওয়েবসাইটগুলি ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগের জন্য ইমেল, প্রোফাইল বানানো, চ্যাট, ভিডিও টেলিফোনি প্রভৃতির মাধ্যমে। ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সমস্ত ধরণের মতামত ও তথ্য আদানপ্রদানের জন্য এগুলো আমরাও ব্যবহার করি। কিন্তু এই কোম্পানিগুলি আমেরিকান রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি, যথা এফবিআই বা এনএসএকে আমাদের সমস্ত তথ্যাবলি সরবরাহ করে চলেছে। এদের প্রত্যেকে ব্যবহারকারী, অর্থাৎ আমাদের তথ্যগুলি (নাম, বয়স, ফোন নম্বর, স্কুলের নাম, বরের নাম, কার সঙ্গে কি কি চ্যাট করলাম তা থেকে শুরু করে আমরা ওইসব ওয়েবসাইটে গিয়ে কি কি শব্দ ‘সার্চকরেছি, এমনকি ওইসব ওয়েবসাইটে দেওয়া লিঙ্কগুলোর মধ্যে কোন কোনগুলিতে মাউস ক্লিক করেছি, কোন শহরের কোন কম্পিউটার থেকে ইন্টারনেট সার্ফ করছি সঅব) তারা যে মহাফেজখানায় রাখে সেই সার্ভার কম্পিউটারগুলি মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এবং ওই গোয়েন্দা সংস্থাগুলি সেই তথ্যগুলি কপি করে চলেছে নিয়মিত। ২০০৭ সাল থেকে চলা এই কর্মকাণ্ডের ডাকনাম ‘প্রিজম

ফাঁস হওয়া মার্কিন রাষ্ট্রের নথির একটি পাতা
ফাঁস হওয়া মার্কিন রাষ্ট্রের নথির একটি পাতা

সম্প্রতি মার্কিন গুপ্তচর সংস্থার এক চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী এই প্রিজম কর্মকাণ্ডের তথ্য সম্বলিত কিছু নথি ফাঁস করে দিয়েছে ইংলন্ডের ‘দ্য গার্ডিয়ানএবং আমেরিকার ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস্‌পত্রিকার কাছে। ৬ জুন এই দুই কর্পোরেট মিডিয়া সেইসব নথির কিছু অংশ প্রকাশ করেছে। আর তাতেই ঢি ঢি পড়ে গেছে গোটা দুনিয়ায়। শুধু এই ণ্ণপ্রিজমকর্মকাণ্ডই নয়, ওই বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করার জন্য রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি একটি সফটওয়রও বানিয়েছে, নাম ‘বাউন্ডলেস ইনফরম্যান্ট। এর মাধ্যমে এই তথ্য থেকে চাইলে তারা এক লহমায় বের করে ফেলতে পারে, আপনি গত দশ বছরে ইন্টারনেটে কার কার সাথে কতক্ষণ চ্যাট করেছেন, কি কি ওয়েবসাইট ভিজিট করেছেন, কোন কোন কম্পিউটার বা মোবাইল বা ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ থেকে ইন্টারনেটে ঢুকেছেন সবই। চাইলে তারা এক লহমায় বের করে ফেলতে পারে, কলকাতা শহরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদির সমর্থক কারা, তাদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, পেশা, লিঙ্গ প্রভৃতি। হ্যাঁ, এগুলি তারা করতে পারবে না, যদি আপনি আপনার তথ্য গোপন করেন। যদি আপনি ইচ্ছে করে আপনার কম্পিউটারের পরিচয় জ্ঞাপনকারী নাম্বার, যাকে কম্পিউটার পরিভাষায় আইপি বলে, তাকে গোপন করেন কোনও সফটওয়রএর মাধ্যমে। কিন্তু আপনি যদি এসব করেন, তাহলে মাইক্রোসফট, গুগল, ফেসবুক, ইয়াহুরা খুব অসন্তুষ্ট হয়। তারা তাদের পরিষেবা আপনাকে প্রায় ব্যবহার করতেই দেবে না। বারে বারে প্রশ্ন করবে আপনাকে, সেসব উত্তর দিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করতে পারলে তবে আপনি ফেসবুক বা জিমেলএ ঢুকতে পারবেন। অর্থাৎ আপনার পাসওয়র্ডটি যথেষ্ট চাবিকাঠি নয়। এবং ওরা এইসব প্রশ্ন করবে আপনার ‘অ্যাকাউন্ট‘-এর নিরাপত্তার দোহাই পেরে।

ফাঁস হওয়া মার্কিন রাষ্ট্রের নথির একটি পাতা
ফাঁস হওয়া মার্কিন রাষ্ট্রের নথির একটি পাতা

মার্কিন গোয়েন্দাসংস্থাগুলির এই গোপন উদ্যোগ ফাঁস হয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় উক্ত কোম্পানিগুলি প্রাকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছে অভিযোগগুলি। তবে সরাসরি কেউ স্বীকার করেনি, বরং প্রত্যেকেই বলেছে, ‘আমরা আমাদের সার্ভারগুলি সরাসরি কোনও সরকারি সংস্থাকে ব্যবহার করতে দিই না।কিন্তু ইন্টারনেটে ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার নিয়ে লড়াই চালিয়ে আসা সংগঠন ইলেকট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ওরা সত্যিটা স্বীকার করবে না। কারণ মার্কিন আইনেই আছে, যদি রাষ্ট্র তাদের কাছ থেকে তথ্য নেয়, তাহলে তা প্রকাশ করা যাবে না। আর আরেকটি কারণ সহজেই অনুমেয়, যদি কোনও ইন্টারনেট কোম্পানি স্বীকার করে নেয়, তাদের তথ্য গোপন থাকে না, তাহলে স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তা প্রেমী ইন্টারনেট দুনিয়ায় সেই কোম্পানি জনপ্রিয়তা হারাবে। অন্তত মার্কিন ও ইউরোপীয় বাজারে তো বটেই। এবং অমার্কিন রাষ্ট্রগুলিও ওইসব কোম্পানিগুলিকে নিষিদ্ধ করে দিতে পারে।

Prism_slide_5
ফাঁস হওয়া মার্কিন রাষ্ট্রের নথির একটি পাতা

মার্কিন রাষ্ট্রের পক্ষে ওই সার্ভারগুলিতে হাত দেওয়া সহজ। কারণ প্রথমত, ওপরের সবকটি কোম্পানিই মার্কিন দেশের কর্পোরেট। মার্কিন মুলুকে সার্ভার কম্পিউটারে তথ্য রাখা সবচেয়ে সস্তা। ফলে ভারত থেকে ব্যবহারকারীদের তথ্যও তারা ওই মার্কিন দেশের সার্ভারেই রেখে দেয়, যদিও তা ভারতের কোনও সার্ভারে রাখা সবচেয়ে সোজা। কিন্তু সহজের থেকে সস্তার দিকেই কর্পোরেটদের নজর বেশি।

ফাঁস হওয়া মার্কিন রাষ্ট্রের নথির একটি পাতা
ফাঁস হওয়া মার্কিন রাষ্ট্রের নথির একটি পাতা

মার্কিন রাষ্ট্র খুব দ্রুত এই ‘প্রিজমএবং ‘আনবাউন্ড ইনফর্মান্ট‘-এর অস্তিত্ব স্বীকার করেছে। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি ওবামা বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এসব করা হচ্ছে। করা হবেও। নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এই দুটিই একসঙ্গে চাই তা তো হতে পারে না! তবে কতটা নিরাপত্তা চাই আর কতটা গোপনীয়তা চাই সে বিষয়ে ‘পাবলিক ডিবেটকরা যেতে পারে।

প্রসঙ্গত, উইকিলিকসএর কর্ণধার জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ সহ আরও কয়েকজনের লেখা একটি বই, ‘সাইবারপাঙ্কস‘ —(২০১২ সালে প্রকাশিত) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ আরও কয়েকটি শক্তিশালী দেশের এই ধরণের কার্যকলাপের কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু কোনও প্রামাণ্য তথ্য দেওয়া হয়নি। ফাঁস হওয়ার পর দেখা গেল, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জদের আশঙ্কা ও অনুমানের তুলনায় বাস্তবটি আরও ভয়াবহ