- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘মরবে যখন আমাদের চোখের সামনেই মরুক’

 অমিতাভ সেন, কলকাতা, ১৭ মার্চ#

‘সিস্টার, ২৬ নম্বর বেডের রুগি মাটিতে পড়ে গেছে।’ শুনে সিস্টার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দুজন স্টাগকে ডেকে রুগিকে বেডে তোলালো। মেঝেতে কয়েক ফোঁটা রক্ত। রুগুর কপাল কেটেছে। আগে যত চেঁচাচ্ছিল, এখন তা আরো বেড়েছে।
আমি গিয়েছিলাম ২৫ নম্বর বেডের রুগিকে দেখতে। রুগি কাটোয়ার এক বন্ধু। জন্ডিসের জন্য ভর্ত্তি হয়েছে। আগে যাদবপুরে কেপিসি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ওখানে প্রচুর খরচ, তাই প্রথমে পিজি হাসপাতাল এবং সেখানে সিট না পাওয়ার পরে এখানে এসে এই শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে। অবশ্য ঘরের মধ্যে জায়গা হয়নি, করিডোরে বেড পাতা আছে লাইন দিয়ে ২৫, ২৬, …। বন্ধু বলল, হাসপাতালের খাবার খেতে পারছে না ঠিক। আলুসেদ্ধটা খেয়েছিল, মাছ খেয়ে বমি হয়েছে। রক্তের একটা টেস্ট করতে দিয়েছে বাইরে — কাল তার রিপোর্ট পাওয়া যাবে। তারপর ডাক্তার বলবে কী করতে হবে।
আমি দেখছিলাম একটা ছোটো খাটো চেহারার বউ এসে ২৬ নম্বর রুগির জামা পালটে দিচ্ছে। ভিজিটিং আওয়ার্সের পরে হাসপাতালের গেটে সেই বেডটার সঙ্গে চায়ের দোকানে আলাপ হল। বললেন, রুগি তার স্বামী, নাম সুবল দাস। অসুখ কী জিজ্ঞেস করায় বললেন, মদ খেয়ে লিভার খারাপ হয়েছে, আগে পেটে জল জমেছিল, সব ফুলে যাচ্ছিল। তখন রামরিক হাসপাতালে তিন মাস ভর্তি ছিল, সেরেও গেছল। এবার ডাক্তার বলেছে, লিভার খারাপ, সঙ্গে টিবি। টিবির সাত আট রকম কড়া কড়া ওষুধ দিলে ওরকম বেঁকে যায়, তখন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা জিনিস না খাওয়ালে হয়। দেখলে তো আজামা পাল্টাতে আমার কী কষ্ট হচ্ছিল, একা আমি পারি একটা পুরুষ মানুষকে সামলাতে। পড়ে গিয়ে মাথা কেটে গেল, আমি তখন থাকবো কী করে। সবসময় থাকতে পারি? সাত বাড়ি কাজ করে সংসার চালাই। লোকটা তো কোনও কাজ করত না, মাঝে মাঝে জোগাড়ের কাজ করত আর সব মদের পেছনে ঢালতো। বয়স বেশি হয়নি। ছেলের বয়স ২১ বছর, তাহলে বয়স কত বোঝো। আমার থেকে দু-বছরের বড়ো হবে। আরেকটা মেয়ে আছে, তার বিয়ে দিয়েচ দিয়েছি, এখন বাড়ি ডেকে এনেছি, একটু রান্নাবান্নায় সাহায্য করতে বাড়ি বেশি দূরে নয়, কালীঘাটের ট্রাম ডীপোর পেছনে মসজিদ আছে না — সাহেববাগান বলে। আমাকে সাতবাড়ির কাজ সামলে হাসপাতালে আসতে হয়। সকাল ১১ টায় এসে খাইয়ে দিয়ে যাই। ছেলেটা প্যারিসের কাজ করে। সে কাজ সেরে রাত সাড়ে আটটায় এসে বাপকে জামা-কাপড় পালটে খাইয়ে দিয়ে যায়। আবার ভোরে উঠে তিনটে হাড়ি ধোয়, তারপর প্যারিসের কাজে চলে যায়। সে আসবে কী করে। হাসপাতালের লোক বলছে, বাড়ির লোককে থাকতে। আমার তো আর লোক নেই। এপক্ষেও বাবা-মা নেই, ওপক্ষেও কেউ নেই। কয়েকদিন আয়া রেখেছিলাম। ৮০ টাকা করে রোজ। এই পাঁচ রবিবার হয়ে গেলো লোকটা ভর্তি আছে। রোজ আয়া রাখার অত টাকা পাবো কোথায়। লোকটা পড়ে গিয়ে চোট পেল। আগের কদিন ভালো ছিল। বেড থেকে নেমে এদিক ওদিক চলে যেত। মাথাটাও ঠিকনেই। একটি পাগলের মতো করলেও খারাপ ছিল না। এদিক ওদিক চলে যেত বলে বেঁধে রেখেছিল। কাল ভাবছি ডাক্তারকে বলে বাড়ি নিয়ে যাব — মরবে যখন মরুক, আমাদের চোখের সামনেই মরুক।
এত কথা বলে ফেললেন সুবল দাসের বউ। আমি শুধু বলেছিলাম, রুগি পড়ে যাওয়ায় নার্সকে ডাকতে গিয়েছিলাম আমি, তখন ওরা বাড়ির লোকের খোঁজ করছিল। সন্ধ্যের অন্ধকার তখন গাঢ় হচ্ছে। তার চেয়েও গাঢ় যন্ত্রণার অন্ধকার সুবল দাসের বউ-এর মুখে — উনি যখন পড়ে গিয়েছিলেন তখন নিজে উপস্থিত ছিলেন না বলে। আর সে জন্যই বোধহয় প্রায় অপরিচিত আমাকে এতগুলো কথা বলে একটু কষ্ট ভাগ করে নিলেন।