- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

মনসান্টোর দুনিয়াদারি

২১ সেপ্টেম্বর, জিতেন নন্দী, কলকাতা#

The-world-according-to-monsant

২১ সেপ্টেম্বর দুপুরে ডিআরসিএসসি নামক এক সংস্থার আয়োজনে একটা তথ্যচিত্র দেখলাম। বেশ লম্বা একটা ধারাবিবরণ, কীভাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে পৃথিবীময় একটা ধ্বংসযজ্ঞ করে চলল একটা কোম্পানি — মনসান্টো। ২০০৮ সালে মেরি মনিক রবিন এই ছবিটা তৈরি করেছিলেন। টানা তিনবছর দেশে দেশে ঘুরে তিনি মনসান্টোর দুনিয়াদারি প্রত্যক্ষ করেন। আমাদের ভারতেও এসেছিলেন। এরপর তিনি ণ্ণদ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাকর্ডিং টু মনসান্টো’ নামে একটি বই ও একটি তথচিত্র প্রকাশ করেন। প্রথমে এর ভাষা ছিল ফরাসি, পরে অন্যান্য ভাষায় তা অনুবাদ করা হয়।\par
মনসান্টোর দুনিয়াদারি শুরু হয়েছিল আমেরিকায় ১৯০১ সালে। আজ পৃথিবীর ৪৮টা দেশে তার উপস্থিতি। আমাদের চিরাচরিত চাষআবাদ, পশুপালন এবং খাদ্যাভ্যাসের ওপর মনসান্টোর প্রচণ্ড প্রভাব নিয়ে গোটা পৃথিবী আজ শঙ্কিত।

সয়াবিনের ওপর গর্জে উঠল বন্দুক

রাউন্ডআপ রেডি সয়াবিন হল এমন এক ব্র্যান্ডের সয়াবিন যার জার্মপ্লাজমের মধ্যে মনসান্টোর বিজ্ঞানীরা জিন-বন্দুকের সাহায্যে নানা জেনেটিক উপাদান ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিকভাবে এই সয়াবিন বিক্রির অনুমোদন পায়, ১৯৯৭ সালে উরুগুয়ে, ১৯৯৮ সালে মেক্সিকো ও ব্রাজিলে এবং ২০০১ সালে আফ্রিকার বাজারে তা বৈধতা পায়। এই সয়াবিন খাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়।
সিনেমাটা দেখতে দেখতে প্রশ্ন জাগে, জানি না, ভারতে আমরা যে নিউট্রিলা, নিউট্রি-নাগেট ইত্যাদি সয়াবিনের বড়ি খাই কিংবা সয়াবিনের তেল দিয়ে রান্না করি, তা ওই জাতের সয়াবিন কিনা।

দূষিত পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল (পিসিবি)

মনসান্টোর তৈরি ও বিক্রি করা বহু জিনিস এখন পৃথিবীর বহু দেশে নিষিদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পজগতে যত পিসিবি ব্যবহার হত, তার ৯৯\% সরবরাহ করত মনসান্টো। ১৯৭৭ সালে তার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এই ভয়ঙ্কর জৈব দূষণকারী বস্তুটা মানুষ সহ যে কোনো প্রাণীর শরীরে ক্যানসার রোগের জন্ম দেয়। অতীতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রান্সফর্মার ও ক্যাপাসিটর তৈরির জন্য, ইলেক্ট্রিক তারের পিভিসি কোটিংয়ের জন্য এই পিসিবির বহুল ব্যবহার ছিল। কিন্তু তা খুবই বিষাক্ত একটা জিনিস। ১৯৭৯ সালে মার্কিন কংগ্রেস এবং ২০০১ সালে স্টকহোম কনভেনশন অন পার্সিস্টেন্ট অর্গানিক পলিউটান্টস পিসিবি উৎপাদন নিষিদ্ধ করে।

গরুর দুধের উৎপাদন বাড়াতে rBST  ইঞ্জেকশন প্রয়োগ

বোভাইন সমাটোট্রপিন (সংক্ষেপে BST)  অথবা বোভাইন গ্রোথ হরমোন (সংক্ষেপে BGH)  হল এক ধরনের পেপটাইড হরমোন, গরুর পিটুইটারি গ্ল্যান্ডে থাকে। ১৯৭০-এর দশকে জিনেনটেক নামে এক বায়োটেক কোম্পানি এর জিন আবিষ্কার করে এবং তার পেটেন্ট নেয়। এর ফলে কৃত্রিম উপায়ে rBST  অথবা rBGH  তৈরি করা সম্ভব হয়। মনসান্টো সমেত চারটে ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে rBST  প্রোডাক্ট তৈরি করে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে অনুমোদন চায়। মনসান্টো প্রথমে এর অনুমোদন পায়। পরে মেক্সিকো, ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়া এবং আরও দশটি দেশ এর বাণিজ্যিক অনুমোদন পায়। কিন্তু কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, ইসরায়েল এবং সমস্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর বাজারে এটা ঢুকতে পারেনি। আমেরিকায় জনমতের চাপে কিছু ব্যবসায়ী সংস্থা দুধের বিক্রির সময় rBST  -ফ্রি লেবেল লাগাতে বাধ্য হয়।

সিনেমার পর্দায় এসব দেখে ভয় পাই, আমাদের ছেলেমেয়েরা যে চকোলেট-ক্যাডবেরি ইত্যাদি খেতে পছন্দ করে, তার মধ্যেও তো দুধ থাকে। সেই দুধ কি rBST  -মুক্ত?

কিছু দিক্‌পাল চরিত্র

সিনেমায় উঠে এল কিছু দিক্‌পাল মানুষের ছবি ও কথা।
ড্যান গ্লিকম্যান নামে এক মার্কিন ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ ১৯৯৫ থেকে ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ এগ্রিকালচার হিসেবে কাজ করেন।
খাদ্যশস্য ও ওষুধের জিনগত পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষেত্রে আলোকপাত করেন জেম্‌স মারিয়ানস্কি। তিনি ছিলেন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্স সেন্টার ফর ফুড সেফটি অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড নিউট্রিশন-এর বায়োটেকনোলজি কো-অর্ডিনেটর। ১৯৭৭ সালে তিনি এই কাজ শুরু করেন। বায়োটেকনোলজি সংক্রান্ত নীতিসমূহ প্রস্তুতের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ সংযোগকারীর ভূমিকা নেন।
মাইকেল টেলর হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর ডেপুটি কমিশনার ফর ফুড্‌স। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে তিনি মনসান্টোর পাবলিক পলিসি বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে কাজ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য-রাজনীতির মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন এই মানুষগুলো।
ড. স্যামুয়েল এস এপস্টাইন একজন চিকিৎসক। ক্যানসার রোগের যেসব কারণ রোধ করা যায়, তা নিয়ে তিনি অমূল্য কাজ করেছেন। দুধে rBST  -র মতো গ্রোথ হরমোনের প্রভাব নিয়ে তাঁর লেখা মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সমালোচনার মুখে পড়ে। কোনো খাবার বাজারে বিক্রি করলে তার গায়ে লেবেল সাঁটার প্রসঙ্গ মনসান্টোর মতো সংস্থাকে অস্বস্তিতে ফেলে।
রবার্ট বি শ্যাপিরো নামে এক মার্কিন ধনী ব্যবসায়ী ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মনসান্টোর পরিচালন-কর্মে নিযুক্ত ছিলেন।

ঘূর্ণায়মান দরজার কেরামতি

মনসান্টোর যাবতীয় কুকীর্তির সাফাই দেওয়ার কাজ করেছে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতো সরকারি বিভাগ। সেই কুকীর্তি যখন নানাভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ল, তখন একটা রসিকতা শোনা যায়, সরকারের সঙ্গে মনসান্টোর ণ্ণরিভল্ভিং ডোর’, যে ঘূর্ণায়মান দরজার একদিক দিয়ে ঢুকে আর একদিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায়। যখনই মনসান্টোর জেনেটিকালি মডিফায়েড দুধ ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সরকার সার্টিফিকেট দিয়ে দেয় আর মিডিয়া প্রচার করে, সেই দুধ নিরাপদ।

কিন্তু তা সত্ত্বেও মনসান্টোর অপরাধ ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। স্টিভেন এম ড্রুকার নামে একজন আইনজ্ঞ জনসমক্ষে প্রমাণ করে দেন, জিন পরিবর্তিত খাদ্য (জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ার্ড ফুড) সম্পর্কিত মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের নীতি বিজ্ঞান ও মার্কিন আইনকে লঙ্ঘন করে চলেছে।
দেখা গেছে, এরকম বহু ব্যক্তি, যাঁরা মার্কিন পরিবেশ দপ্তর, ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং সুপ্রিম কোর্টের মতো রাষ্ট্রীয় কর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁরা মনসান্টোতেও কোনোসময় উচ্চপদে কাজ করেছেন।

জিএম ফুড ব্যাপারটা কী?

মনসান্টো এবং বায়োটেকনোলজি ইন্ডাস্ট্রি বোঝানোর চেষ্টা করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হল এক ধরনের মামুলি প্রজনন করার পদ্ধতি। বিভিন্ন দেশের সরকার এইভাবে প্রস্তুত খাদ্য (জিএম ফুড) কতখানি নিরাপদ, তা খতিয়ে দেখতে চায় না। কিন্তু চিরাচরিত প্রজননের পদ্ধতি থেকে এটা সম্পূর্ণ আলাদা। জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ার্ড উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পূর্ণ কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়। এর মধ্যে দিয়ে জিনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা নষ্ট হয়ে যায় এবং তা কোনোভাবেই নিরাপদ নয়।

আর্পাড পুস্‌তজাই জিএম আলু নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পান, পরীক্ষাগারে ইঁদুরের দেহে তা প্রয়োগ করে খারাপ ফল পাওয়া যাচ্ছে। তাঁকে তাঁর সংস্থা, স্কটল্যান্ডের রোয়েট ইন্সটিটিউট সাসপেন্ড করে এবং তাঁর সেই ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই কুকর্মে মিডিয়া হাত মেলায়। কিন্তু এটা জানতে পেরে ইউরোপ ও আমেরিকার ২১ জন বিজ্ঞানী ১৯৯৯ সালে তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসেন।

১৯৯০-এর দশকের শেষ এবং ২০০০-এর গোড়ার দিকে যখন ভারতে ঋণগ্রস্ত তুলাচাষিদের আত্মহত্যা সকলের নজরে এল, দেখা গেল কাঠগড়ায় রয়েছে মনসান্টোর জিএম তুলা বীজ। অধিক ফলনের আশায় বুক বেঁধে চাষিরা সর্বস্বান্ত হয়েছে।

যে মার্কিন চাষিসমাজ মনসান্টোর উৎপাদিত বস্তু ব্যাপকভাবে চাষে ব্যবহার করেছে, শেষপর্যন্ত তারাই মনসান্টোর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলল।