- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

ভূমিকম্পের নেপাল থেকে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ঘরে ফেরা

অলোকেশ মণ্ডল, বাগনান, ২৯ এপ্রিল#

মিথিলা এক্সপ্রেস এ ফেরার ছবি প্রতিবেদকের। ২৭ এপ্রিল।
মিথিলা এক্সপ্রেস এ ফেরার ছবি প্রতিবেদকের। ২৭ এপ্রিল।

কাজের সুবাদে মাসে এক দুবার নেপাল যেতে হয়। যাতায়াতের টিকিট অগ্রিম কাটা থাকে। মিথিলা এক্সপ্রেসে এবারেও গিয়ে পৌঁছলাম ২৫ এপ্রিল। নেপাল-বিহারের বর্ডারে রক্সৌল স্টেশনে যখন গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখনই প্রথম কম্পনটা অনুভব করলাম। বাড়িতে ফোন করে জানলাম। একই অভিজ্ঞতা। বেশ বড়োসরো ভূমিকম্প আন্দাজ করলাম। ঘন্টাখানেক পর স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে নেপালের বীরগঞ্জ গিয়ে পৌঁছলাম। থমথমে আতঙ্কের পরিবেশ। নেপালে শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। দোকানপাট বন্ধ। বেশিরভাগ মানুষ বাড়ির বাইরে। পরপর দু-বার মাটি কেঁপেছে। শুনলাম কাঠমাণ্ডুতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমাদের কাজের লোকজন বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে। তবে পাহাড়ের কেউ নেই। টিভি দেখার সুযোগ নেই, তাই রেডিওতে কান পাতলাম।
শুনলাম সিন্ধুলিতে ঘরবাড়ি পড়ে গেছে। তার ৪০ কিমি দক্ষিণে বদ্রীবাসে আমাদের ১০ জন কারিগর কাজে গেছে। বাসে বীরগঞ্জ থেকে ৪ ঘন্টা লাগে। চিন্তা হলো। ফোন করে জানলাম। সব কিছু ঠিক আছে। তবে কয়েক কিলোমিটার দূরে জনকপুরে সীতার জন্মস্থান বলে পরিচিত জনকরাজার প্রাসাদ ও মন্দির ভেঙে গেছে বলে জানালো। পাঁচতলা হোটেলের ওপরে দু-টি তলায় কাজ হচ্ছে। আশেপাশে আর কোনো উঁচু বাড়ি নেই। ভূমিকম্পের পর সবাই বাইরে। ঘন্টাখানেক পরে ফোন এল — ওই তালগাছের মতো বাড়িটাকে যেভাবে দুলতে দেখেছে, তাতে আর একটা রাতও ওখানে কাটানো সম্ভব নয়। তাই ৭ জন বীরগঞ্জ যাবার জন্য বাস ধরেছে। যারা রইল, তাদের সতর্ক হয়ে রাতটা জেগে কাটানোর পরামর্শ দিলাম। স্থানীয় বিভিন্ন রেডিওতে বার বার কখনো ২৪ ঘন্টা কখনো ৪৮ বা ৭২ ঘন্টার জন্য সতর্ক থাকার জন্য বলছিল। বীরগঞ্জে তেমন ঠাণ্ডা নেই, আকাশে মেঘ ছিল না, বৃষ্টিও হয়নি। বাড়ির নিচের তলাতে সবাই সতর্ক হয়ে কিংবা ফাঁকা জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে বহু মানুষ রাত কাটালো। কয়েক জায়গায় টিভিতে খবর বা খবরের ফাঁকে ফাঁকে সিনেমা দেখে রাত্রি জাগরণের প্রয়াস দেখলাম। শেষ রাতে বেশ ঠাণ্ডা লাগায় গায়ে জ্যাকেট চড়াতে হলো। সে রাতে ১১-৩০, ১-০০, এবং ভোররাতে ৫-৩০ এ মোট তিনবার কম্পন বুঝে মানুষ উৎকন্ঠিত হয়ে রাস্তার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছিল।
রাত জাগার অলসতা কাটিয়ে যখন সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন মানুষ কাজে ফিরছে তখন রবিবার দুপুরে আবার বেশ ভালোরকম মাটি কেঁপে ওঠায় আতঙ্ক চরমে উঠল। বদ্রীবাস থেকে বাকি ৪ জন কারিগর রওনা দিল বাড়ির উদ্দেশ্যে। আর বারণ করা যায় না। নিতিনপুর আর বীরগঞ্জে যারা ছিল, তারাও সঙ্গ দিল। কোনোমতেই আর নেপালে রাত কাটানো সম্ভব নয়। ট্রেন ধরতে গেলে আবার রাত কাটাতে হবে, তাই সবাই পাটনা গিয়ে তারপর ট্রেনে হাওড়া হয়ে বাড়ি যাবার প্রয়াস নিল। যার কাছে যা টাকা পয়সা সম্বল ছিল, তার ওপর ভরসা করে মিলেমিশে যে যার বাড়ি গেলেই শান্তি। গতকাল থেকে অনেকের বাড়ি থেকে ফোন আসছে, বিদেশ বিভুঁই-এ আহত হওয়ার চেয়ে বাড়িতে এসে মরা অনেক ভালো। পরিস্থিতি জটিল হতে পারে কি না এই পর্যবেক্ষণের জন্য আমি বীরগঞ্জে আর একটা রাত কাটানোর প্রয়াস নিলাম।
রবিবার রাতটাও আতঙ্কের রাত ছিল। আমরা তিনজন একতলা টিনের ছাউনিতে থাকতেও ভরসা পাচ্ছিলাম না। বাইরে উঠোনে একটা খাটিয়া বের করেছিলাম নিশ্চিন্তে ঘুমনোর জন্য। কিন্তু উত্তরে হাওয়ায় ঠাণ্ডা লাগছিল, আর আমাদের কাছে কোনো কম্বল ছিল না। তাই পালা করে রাতটা জেগেই কাটল। এবং বেশিরভাগ মানুষ জেগেই কাটিয়েছে।
পরদিন সকালে রান্না করে খেয়ে সাত তাড়াতাড়ি নেপাল থেকে ভারতে এলাম সেই রক্সৌল স্টেশনে। অনেক ভীড়। বেশিরভাগই বাঙালি। সময়মতো গাড়ি এল। রিজার্ভেশন বগীতে জায়গা নেই। মিথিলা এক্সপ্রেসে চারটে জেনারেল বগি থাকে। তাড়াতাড়ি উঠে তারই একটায় জানলার ধারে জায়গা পেলাম। কিন্তু এক মিনিটের মধ্যেই কামরা খালি করে নেমে এলাম। ওই বগিটা আজ সেনাবাহিনীর জন্য রিজার্ভড। কোনোমতে বচসা করে অন্যত্র জায়গা করে নিতে হলো। সেনাবাহিনী উপকারে লাগে না অপকারে লাগে, সেই চিন্তা রয়েই গেল।
বাঙালি সহযাত্রীরা জানালো যে তারা কাঠমাণ্ডু থেকে আসছে। আজকের মিথিলা এক্সপ্রেস-এ ওরা নিজেরা ২০ জন আছে। তা ছাড়াও পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না, যেখানে ওদের বাড়ি, সেই এলাকার আরো শ-দুয়েক লোক এই ট্রেন-এ আছে। কাঠমাণ্ডুতে ওরা বাঙালী ঠিকাদারের কাছে মার্বেল পাথরের কাজ করে। সেখানে ওরা চোখের সামনে বড়ো বড়ো পাকা বাড়ি ভেঙে পড়তে দেখেছে। ওদের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে তিনজনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটা রাত কোনোরকমে কাটিয়ে ওরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। নেপালে ওরা সেনাবাহিনীর সাহায্য পেয়েছে। ট্রেনের টিকিট কাটেনি কেউ। জানালো যে সরকার নাকি যাতায়াত ফ্রি করে দিয়েছে। ট্রেনে ৪ জনের বসার সিটে ৭ জন করে বসেছে। ওপরে লোহার বাঙ্কে কাঠের পাটাতনের ফাঁক সত্ত্বেও ৫-৬ জন গাদাগাদি করে জায়গা করে নিয়েছে। জানলার ধারের সিট আমাকে একটু স্বস্তি দিয়েছে। দুপুরের দিকে ভ্যাপসা গরমেও অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। বুঝলাম, দু-রাতের ক্লান্তি আর বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা ওদের চোখে শান্তির ঘুম এনে দিয়েছে।