- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

ভারত-বাংলাদেশের ১৬২ টি ছিটমহলে নয়া স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস

রহমান আলী, পোয়াতুরকুঠি, দিনহাটা,কোচবিহার, ১০ আগষ্ট#

Coochbehar
৩১ জুলাই ২০১৫ মধ্যরাত থেকে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়দেশের ১৬২ টি ছিটমহল বিনিময়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ভারতের মূল ভুখন্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫১টি এবং বাংলাদেশের মূল ভুখন্ডের সঙ্গে ভারতের ১১১টি ছিটমহল মিশে যায়। সেদিনের সেই স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দ উৎসব উদ্‌যাপিত হয় ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশী ছিট মশালডাঙ্গায়। বিবিসি থেকে শুরু করে টাইম্‌স অফ ইন্ডিয়ার মত তাবড় তাবড় সংবাদ মাধ্যমগুলি সেদিন উপস্থিৎ ছিল। আরও উপস্থিৎ ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিও। প্রথমে সন্ধ্যা ৮টায় দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে মঞ্চে পাঁচটি ঘটনাকে তুলে ধরা হয়, সেগুলি হল — (১) ২৯ মার্চ ২০১০ সালে জেহাদ হোসেন ওবামার জন্ম। (২) ২০১১ সালে ময়মনা খাতুনকে ছিটমহল থেকে বিধানসভা ভোটে দাঁড় করানো। (৩) ১২ মার্চ ২০১২ সালে ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে ২৮ দিনের অনশন আন্দোলন (৪) ছিটমহল পরিস্থিতি নিয়ে মশালডাঙ্গা ছিটমহলের বাসিন্দা মালেকা বিবি গানের প্রচার (৫) ২০১২ সালে গঠিত ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির ফেসবুক পেজ এবং ফেসবুক টুইটারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার চালানো।
তারপর রাত ৯টায় ছিটবাসীদের সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে নির্মিত একটি ২৫ মিনিটের তথ্যচিত্র দেখানো হয়। এরপর আধঘন্টার মত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ থেকে আসা আব্রাহাম লিঙ্কন এবং ভারতের পক্ষে সৌমেন দাস, দীপ্তিমান সেনগুপ্ত এবং আরও অনেকে।
এরপর ভারতীয় সময় ১২টা বেজে ০১ মিনিটে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাননীয় বিধায়ক শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয়। শুরু হয় বাজি ফাটানো, ওড়ানো হয় ফানুস।

দীর্ঘ ৬৮ বছরের যন্ত্রণাময় জীবন থেকে মুক্তির আনন্দকে স্মরনীয় করে রাখতে প্রতিটি বাড়িতে জ্বালানো হয় ৬৮টি করে মোমবাতি ও একটি করে মশাল। মশালডাঙ্গা ছিটের সবচেয়ে প্রবীন বাসিন্দা ১০৬ বছর বয়েসি আজগর আলি বলেন ‘আজ আমার খুব খুশি লাগছে, ভাবতেই পারিনি আমি ছিটমহল বিনিময় দেখে যেতে পারব। এখন ছিটবাসীরা সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পাবে’। মশালডাঙ্গার যুবক সম্প্রদায় সাদ্দাম হোসেন, কবিরুদ্দিন এবং জয়নালরা বলেন ‘আজ আনন্দের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি, দীর্ঘ ৬৮ বছর পর এই স্বাধীনতা। এখন পড়াশোনা করতে মিথ্যে বাবা সাজাতে হবে না। নিজের বাবার পরিচয়েই সব নাগরিক অধিকার পাওয়া যাবে’। তাদের দাবি সরকার যেন প্রতিটি জমিতে গিয়ে জমি জরিপ করে। ১ আগষ্ট পোয়াতুর কুঠিতে সকাল ৯টায় কোচবিহারের জেলাশাসক পি.উলাগানাথন আসেন এবং সরকারী ভাবে তিনি ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সেই সময়ে পরিবেশিত হয় জাতীয় সঙ্গীত। মঞ্চে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন ‘গতকাল মধ্যরাত থেকে ছিটমহল বিনিময়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।এখন আর ছিটমহল নেই। এই এলাকাগুলি এখন ভারতের মুল ভূখন্ডের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। আপনারা এখন স্বাধীন ভারতের নাগরিক। এখন আপনারা স্বাধীন, আমার যা অধিকার আছে, আপনাদেরও একই অধিকার আছে। এই সব এলাকা গুলিতে উন্নয়নের কাজ খুব দ্রুত গতিতেই শুরু হবে। রাস্তাঘাট নির্মান, বিদ্যূৎ স্বাস্থ্য পরিসেবা সবকিছুই এখন হবে’।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে চলা মানবিক আন্দোলন সফল হওয়ায় ৯ আগষ্ট ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। একই দিনে দিনহাটার নৃপেন্দ্রনারায়ন স্মৃতি সদনে এবং বাংলাদেশের পঞ্চাগড় জেলা পরিষদ ভবনের সিলনায়তনে আয়জিত আলোচনা সভায় বিভিন্ন দাবি নিয়ে একটি নতুন সংগঠন ‘নাগরিক অধিকার সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটির মূখ্য আহ্বায়ক নির্বাচিত হন দীপ্তিমান সেনগুপ্ত। যুগ্ম আহ্বায়ক বাংলাদেশ অংশের মইনুল হক ও ভারতের সৌমেন দাস। এছাড়া আহ্বায়ক কমিটিতে রয়েছেন ভারতের  আহসান হাবি এবং বাংলাদেশের গোলাম মোস্তাফা ও মাফিজার রহমান। সংগঠনটির আইনি উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশের আব্রাহাম লিঙ্কন, এবং মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক রক্তিম দাস।

নতুন কমিটি গঠিত হওয়ার পর আলোচনা সভায় দীপ্তিমান সেনগুপ্ত  এই নতুন সংযোজিত এলাকাগুলির উন্নয়নে বিভিন্ন নাগরিক দাবী তুলে ধরে আগামী ১৩ আগষ্ট কোচবিহার জেলাশাসকের কাছে কয়েকদফা দাবি পেশ করা হবে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘এই নতুন সংযোজিত এলাকাগুলি দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত ছিল। কোনও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। সংস্লিষ্ট সংযুক্ত এলাকাবাসীদের ১০০ দিনের কাজ নয় ৩৬৫ দিনের কাজ দিতে হবে। প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার যে সব ছেলেমেয়েরা ভূয়ো পরিচয় দিয়ে পড়াশোনা করছেন এবং সার্টিফিকেট রয়েছে, তাদের সমস্ত সার্টিফিকেট জমা নিয়ে এবং সংশোধন করে নিজের পরিচয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট দিতে হবে। যেভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনগননার কাজ করা হয়েছে সেভাবে প্রতিটি জমিতে গিয়ে ভূমি জরিপ করতে হবে। প্রয়োজনে লোক আদালত গঠন করে জমি সমস্যার সমাধান করতে হবে’।

এরপর তিনি ২৬ জুন দিনটিকে উভয় দেশের সরকারের কাছে ‘আন্তর্জাতিক শহীদ স্মরণ দিবস’ হিসেবে ঘোষনা করার দাবি জানান। এখনেই সংযুক্ত এলাকাবাসীরা আগামি ১৫ আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের বিভিন্ন প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেইদিনই তারা প্রথমবার নতুন ভারতীয় হিসেবে ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করবেন।