- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

বনকাঁথির দেউল

দীপংকর সরকার, হালতু, ১৪ আগস্ট, ছবি লেখকের তোলা#

বনকাঁথি একটি অচেনা ছোট্ট গ্রাম, বর্ধমান জেলার অজয় নদীর তীরে অবস্থিত। ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে একটি নান্দনিক দর্শনীয় স্থান। ঘন জঙ্গল বেষ্টিত হাজার বৎসর পুরোনো একটি ইট নির্মিত টাওয়ার মন্দির দেউলপার্কে অবস্থিত। এই মন্দির ইছাই ঘোষের তৈরি। এখান থেকে দূরে দিগন্ত বিস্তৃত অজয় নদী প্রবাহিত। হাঁটু সমান জল। এই হাঁটু জলে জেলেরা মাছ ধরছে জাল দিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে। নদীর তীরে বালি তুলে গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছে। মন্দিরটি একটু উঁচু জায়গায়। সেখান থেকে অজয়ের তীরের দৃশ্য এক অনন্য অনুভূতি জাগায়।
কথিত আছে এই স্থান আগে ১০৩৮ খ্রিস্টাব্দে গোপভূমি নামে পরিচিত এবং আলাদা স্বাধীন রাজ্য হিসাবে ছিল পাল সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আগে। মহীপালের পুত্র নয়াপালের শাসনের সময় থেকে পাল সাম্রাজ্য ভাঙ্গতে শুরু করে। অনেক স্থানীয় শাসক নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করল শাসন থেকে। এমনই একজন ইছাই ঘোষ নিজেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। ইছাই ঘোষ তখন স্থানীয় রাজা কর্ণ সেনকে পরাজিত করেন, অধুনা বর্ধমানের বিভিন্ন জায়গা অধিকার করেন এবং নিজেকে স্বাধীন গোপভূমির রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন। পরের বছর কর্ণসেনের পুত্র লাউসেন ইছাই ঘোষকে হত্যা করে অজয় নদীর তীরে কাদুনে ডাসা বলে পরিচিত এক স্থানে। ইছাই ঘোষের সময়ই দেউল অর্থাৎ টাওয়ার তৈরি হয়েছিল, যদিও কে তৈরি করেছিলেন, তার কোনো রেকর্ড নেই। কেউ বলেন রাজা চিত্রসেন তৈরি করেছিলেন। ১১ শতাব্দীর ইটনির্মিত এই ৫০ ফুট উঁচু দেউল ৯৭৪ বৎসরের পুরোনো। মন্দিরের ভিতরে শিবলিঙ্গ আছে। লম্বা ও শক্তপোক্ত এই মন্দিরে উড়িষ্যার রথশৈলীর মন্দির স্থাপত্যের প্রভাব স্পষ্ট।
এই মন্দির এখন ণ্ণআর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ দ্বারা সংরক্ষিত। এর সীমানা প্রাচীর দেওয়া আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। মন্দিরেরে গায়ে গাছপালা গজিয়েছে ও চারিদিকে গরুছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে। মন্দিরের পিছনে কাঁকসার জঙ্গল। বাংলার প্রাচীন দূর্গা পূজা এখন এই জঙ্গলে হয়। একে বলে গড় জঙ্গলের শ্যামারূপা।
বনকাঁথি, দেউলপার্ক যেতে গেলে হাওড়া থেকে সকাল ৬-১৫ ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস অথবা হুল এক্সপ্রেসে সকাল ৬-৪৫ এ গিয়ে পানাগড় স্টেশনে নামতে হবে। স্টেশন থেকে দার্জিলিং মোড় গিয়ে ইলামবাজারের বাস ধরতে হবে। নামতে হবে এগার মাইল মোড়। সেখান থেকে বাঁদিকে ট্রেকার ধরতে হবে দেউলপার্ক যাবার জন্য। সমস্ত রাস্তা চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে প্রায় ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। দুপাশে শাল, পলাশের সারি। লাল মাটির রাস্তার ওপর দিয়ে যখন ট্রেকার যায় তখন ধূলোর জন্য নাকে রুমাল দিতে হয়। আলোর ব্যবস্থা খুব একটা চোখে পড়ল না, নেই নগর সভ্যতার আঁচ।
মন্দিরের পাশে একজন ভদ্র মহিলা খোলা আকাশের নীচে চায়ের দোকান দিয়েছেন। মন্দিরের আশে পাশের দৃশ্যও বেশ মনোরম। বাংলার অনেক অতি প্রাচীন মন্দিরগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। এখনও কালের নিয়ম মেনে প্রকৃতির বিরূপতা মেনেই এই মন্দির বহু ইতিহাসের সাক্ষী। আমিও সাক্ষী হয়ে রইলাম সেই ইতিহাসের।