- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

ফের কি ভিনরাজ্যে কাজে ফিরবেন? কোয়ারেন্টাইনে থাকা শ্রমিকদের সাথে কথাবার্তা

ধীমান বসাক। শান্তিপুর। ১২ জুলাই ২০২০।#

২৪ মার্চ, রাত আটটা। টিভিতে সবাই জানলাম রাত আটটার পর থেকে শুরু হচ্ছে এক কঠোর লকডাউন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ঘরের দরজাটাকে ভেবে নিন লক্ষণরেখা, ওর বাইরে পা দেবেন না। আর বললেন, মহাভারতের যুদ্ধ শেষ হতে ১৮ দিন লেগেছিল, করোনার চেইন ভাঙতে ২১ দিন লাগবে।

পরেরদিন সকাল থেকে গোটা দেশ পশ্চিম ভারতের শহরগুলি- দিল্লী, আহমেদাবাদ, সুরাট, অমৃতসর, ইন্দোর, পুনে, ব্যাঙ্গালুরু, চেন্নাই-এর রাস্তায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল দেখতে পেল। খবরের কাগজের ভাষায় যাদের নাম- পরিযায়ী শ্রমিক। এরা এসেছিলেন উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, উড়িষ্যা, বাংলা, আসামের মত রাজ্যগুলি থেকে, পেটের তাড়নায়। লকডাউনে কাজ হারিয়ে তারা নেমে এলেন পথে।

ঠিক তার তিনমাস পরে ২৪ জুন আমরা কয়েকজন গেছিলাম নদিয়া জেলার শান্তিপুরের মালঞ্চ স্কুলমাঠে। ফিরে আসা শ্রমিকদের কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হয়েছিল এই স্কুল। ১৪ দিন পর এই স্কুলমাঠই হয়েছে তাদের আড্ডা দেওয়ার জায়গা। কথা শুরু হল-

-আমার নাম হারুন সেখ। পুনের হোটেলে ওয়েটারের কাজ করি। এখানকার বেশিরভাগ ছেলেরাই হোটেল লাইনে আছে। (পরে বুঝলাম এরা রেস্টুরেন্টকেই হোটেল বলছেন)। পুনের হোটেল কর্মচারীর বেশিরভাগটাই বাঙালি। আমি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর জানাশোনা লোক ধরে দু’বছর আগে পুনে চলে যাই। যখন শুনলাম চারিদিকে করোনা হচ্ছে, ১৫ তারিখ নাগাদ আমাদের মাইনে হল, কিছু টাকা হাতে এল। কী হবে জানা নেই। ভাবলাম বাড়ি চলে যাই।  টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে সোজা শান্তিপুর হাসপাতাল। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে ১৪ দিন বন্দী। বাড়িতে দুই ভাই এবং মা বাবা। আমি বড়, ভাইও পুনেতে হোটেলে কাজ করে। দু’জনে একসাথেই ফিরেছি।   

-কী করবে এখন?

এবছর পুঁজি ও করোনার বিরুদ্ধে শ্রমজীবি মানুষের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মে দিবসের পোস্টার এঁকে দিয়েছেন শুভেন্দু দাশগুপ্ত

-হোটেল থেকে তো ডাকছে। কিন্তু আবার যদি লকডাউন হয়! শান্তিপুরে তো তাঁতব্যবসা লাটে উঠেছেই। যখন পড়াশুনা করতাম তখন তাঁত বুনতাম। এখানে যা আয় হত ওখানেও প্রায় একই আয়। কিন্তু ওখানে খাওয়াদাওয়া পেতাম আর হাতে ১৫ দিন অন্তর থোক পয়সাটা পেতাম। সেজন্যই গেছিলাম। এখানে মহাজন সুতো দিচ্ছেনা। দিনে একটা কাপড় বোনার মত দিচ্ছে। মজুরি আগে ছিল কাপড়পিছু ১০০-১১০ টাকা, এখন দেবে বলেছে ৭০ টাকা। তার মধ্যে কারেন্টের খরচ ১২ টাকা। ৮ টাকা যায় নলির খরচ। মেসিনের জন্য টাকা রাখতে হয়। কারণ মেসিন একবার খারাপ হলেই দেড়শ থেকে দু’শো টাকার কমে ঠিক করা যায়না। সব পাওয়ারলুমই প্রায় বন্ধ। এদিকে তাঁতের হাটও বন্ধ। যে দু’একজন বাইরে থেকে আসছে তারাও দাম খুব কমিয়ে বলছে। কী করব জানা নেই।

-আমাদের নাম সানোয়ার সেখ ও হাসিবুল সেখ। আমরা লকডাউনের মধ্যে শান্তিপুরে ফিরেছি। আমি ক্লাস সিক্সে পড়তে পড়তেই পুনেতে চলে যাই। রান্নার কাজ করতাম। ওখানে গিয়ে আস্তে আস্তে শিখেছি। ওখানে গেলেই আগে আপনাকে থালাবাটি ধুতে হবে- তাকে বলে হেল্পার। মাসে ছ’হাজার টাকা এবং খাওয়াদাওয়া। একবছর পর আমাকে কাটাকুটির কাজ দিল। তখন মাইনে আট হাজার টাকা। আস্তে আস্তে রান্নাও শিখলাম। তখন হলাম কুক। তখন পেতাম বারো হাজার টাকা। বাড়ি ফেরার আগে মাসে পনের হাজার পেতাম।

– হোটেলের কাজে কি বাঙালি ছাড়া আর কেউ আছে?

-হ্যাঁ আছে। ওই যে কী বলে- ঘরওয়ালি না কি- উত্তরাখন্ডের…

– ও; গাড়োয়ালি।

-হ্যাঁ হ্যাঁ। রান্নার কাজ বেশিরভাগ গাড়োয়ালিরাই করে।

[বন্ধুদের মধ্যে কথা শুরু হল। গাড়োয়ালে বহু হিন্দুর তীর্থস্থান। আর জনসংখ্যার একটি বড় অংশ নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে। পায়ে হেঁটে যখন যাত্রা হত, তখন এরাই ছড়িদার তথা পূজারী তথা রাঁধুনি তথা গাইডের কাজ করতেন। পাকা রাস্তা যত এগোল, তত এই অংশের মানুষ তাদের পুরোন পেশা হারাল। এখন এরাই বিভিন্ন জায়গায় হোটেলে রাঁধুনির কাজে লেগেছেন। তবে আরো খতিয়ে দেখতে হবে।]

আবারও কথোপকথন শুরু হল।

লোকে হাঁটছে শুনেছিলাম। কিন্তু মালিক থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছিল। মালিক মারাঠি। মালিকের বাবা একসময় ওখানকার মন্ত্রী ছিলেন। খাবার একবেলা দিত পাবলিক। সেটা একটু কমা, খুদকুড়ো-আতপচাল আর নানানরকমের সবজি মিশিয়ে একটা খিচুরি টাইপের। কোনোদিন সবজি হিসাবে সোয়াবিন থাকত। রাতের খাবার দিত মালিক। সেটা এর চাইতে একটু ভালো। দু’মাস কাটবার পর হোটেল শুরু হল। কিন্তু শুধু পার্সেল সার্ভিস। মালিক বলল, মাইনে দিতে পারবনা। কাজ করো, খাও-থাকো। ওদিকে আগের দু’মাসের মাইনে বকেয়া।

[পাশ থেকে একজন শ্রমিক বলে উঠলেন, এমন একটা সিস্টেম করেছে যেন ফিরতে বাধ্য হয়।]

হোটেলের কাজে ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সি ছেলেদের নেয়। একটু বয়স্ক হ’লে আর নেবেনা। বয়স্কদের মিস্ত্রি, যোগালের কাজ করতে হয়। তখন আমি ঠিক করলাম, কাজ করব, মাইনে পাবনা? বরং বাড়ি ফেরাই ভালো। বাস ভাড়া করা হল চল্লিশজন মিলে। নিল দু’লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা। টাকাপয়সা ছিলনা। বাড়ি থেকে টাকা পাঠিয়েছিল। রাস্তায় ধাবায় খাওয়াদাওয়া করতাম। চারদিন লাগল ফিরতে।

-হোটেলে স্থানীয় কেউ কাজ করত?

– হ্যাঁ। লোকাল ছিল। দুইজন ম্যানেজার। দুইজন ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেন মানে যারা খাওয়ার অর্ডার নেয়। একটু লিখতে পড়তে ও দু’চারটে ইংরাজি শব্দ জানতে হয়। অর্ডারটা লিখে নিতে হয়। তাদের মাইনে মাসে পনের হাজার। বাড়িতে আমরা বাবা-মা-চার ভাই ও এক বোন। আমরা চার ভাইই বাইরে কাজ করি। এখানে ঘরে ঘরে বাইরে কাজ করতে যাওয়া লোক পাবেন। ২৪ তারিখ কোয়ারেন্টাইনে গেলাম। খাওয়াদাওয়া সব বাড়ি থেকেই। দু’তিনজন ব্যক্তিগতভাবে দু’একবার দিয়েছিল, কিন্তু সরকার কিছুই দেয়নি। এখানে আমরা একবারে ম্যাক্সিমাম ১২৬ জন ছিলাম। তার মধ্যে ৯০-৯৫ জন পুনের। বাকি সব কেরালার। হোটেলের কাজে কোনো কনট্রাক্টর ধরে যাওয়ার ব্যাপার নেই। ওটা যোগালে রাজমিস্ত্রির কাজে হয়। এখানে এখন সবচেয়ে পুরোন লোক, বাইরে কাজ করে, যে বাইশ বছর বাইরে খাটছে, সে এখন হেডকুক, নিজেকে আর রান্না করতে হয়না, শুধু অর্ডার দেয়। আমাদের ২২-২৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে বাইরের কাজে গেছেন প্রায় ৩০০০ জন। শান্তিপুরের তাঁতব্যবসা মার খেয়েছে আর লোক পেটের দায়ে বাইরে গেছে। এটা বেড়েছে গত দশ বছর ধরে।

এবার সামনে এগিয়ে এল আরো একজন।

  -আমার নাম ঈশা শেখ। বয়স কুড়ি। চার বছর ধরে বাইরে। ক্লাস এইটে পড়তে পড়তে চলে যাই। বাড়িতে বাবা রাজমিস্ত্রি। এক ভাই তিন বোন। এই স্কুলেই পড়তাম। ২০১৬ এ প্রথমে যাই বম্বেতে। প্রথমে বাসন ধোয়ার কাজ করতাম। বেশ বড় হোটেল (রেস্টুরেন্ট)। সেখানে একবছর থেকে এখানে গাজিমের বিয়ে- পরবের সময় আসি। তারপর আর বম্বে না গিয়ে দিল্লির নয়ডায় চলে যাই। সোয়া দু’বছর মতন ছিলাম। ওখানেও বাসন ধুতাম। তারপর হেল্পার হলাম। মাসে ন’হাজার টাকা করে পেতাম। কিছুদিন থেকে বাড়ি ফিরলাম। তারপর গেলাম পুনে। সেখানেও হেল্পারের কাজে লাগলাম। হোটেলে যখন বলল, কাজ কর, পয়সা দিতে পারবনা; তখন ঠিক করলাম হেঁটেই ফিরব। বাড়িতে জানাইনি। সেটা ছিল ২১ এপ্রিল।

-টাকাপয়সা ছিল হাতে?

– না। আমার কাছে কিছুই ছিলনা। যে দু’জন মিলে ফিরব ঠিক করলাম, ওর কাছে দু’হাজার টাকা ছিল। বিশ্বাস ছিল। খবরেও দেখছিলাম বহু জায়গায় লোকে এই হেঁটে ফেরা শ্রমিকদের খাবার দিচ্ছে। আমরাও ঠিক করে নিয়েছিলাম, কোনো আশ্রম-মন্দিরে -মসজিদে রাত কাটাব। মোবাইলে গুগুল ম্যাপে পুনে থেকে কোলকাতা সেট করলাম। একটাই রাস্তা দেখাল। প্রথমে পুনে হাইওয়েতে পড়লাম। তারপর সেখান থেকে উত্তরে নাগপুরের দিকে হাঁটা। আমার ব্যাগটা পিঠে নেওয়ার মত। বন্ধুর ট্রলিব্যাগটা আধঘন্টা হাঁটার পর ভেঙে গেল।

[একজন পাশ থেকে বলে উঠল, ওসব ট্রলি এয়ারপোর্টেই চলে। বড়জোর স্টেশনে। তা’ও ভালো কোম্পানির ব্যাগ হয় তো কথা। ]

ভোর চারটেয় রওনা দিয়েছিলাম। পুনে হাইওয়েতে উঠে ঘন্টাখানেক রেস্ট নিলাম। বন্ধুকে মাথায় ব্যাগ বইতে হচ্ছে, তারপর আবার হাঁটা। কতদূর সেদিন হেঁটেছিলাম জানিনা। রাতে একটা আশ্রমে থাকলাম। পরেরদিন আবার হাঁটা সকালে।

[বক্তার বয়স বড়জোর ২০ কি ২১। রোগা-পাতলা লম্বাটে একহারা চেহারা]

 দেড় দিন মতন হাঁটবার পর বম্বে থেকে লরিতে ফিরছে একদল বাঙালি লেবার দেখতে পেয়ে তাদের সাথে ভিড়ে গেলাম। মোট বাহান্ন জন। মাথায় ছাউনি অবশ্য একটা ছিল। একদল যখন ঘুমোত বাকিরা জেগে বসে থাকত।

বাড়ি ফিরলাম ২৫ এপ্রিল। সকাল পাঁচটায়। কৃষ্ণনগর। সেখান থেকে পুলিশ গাড়ি করে বাড়িতে দিয়ে যায়। ১৪ দিন বাড়িতে ছিলাম। আবার যেতে বললে এখন আর যাব না।

পাশে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলে উঠল, স্টেশনে গেছিলাম পুনের ট্রেন চলছে কিনা জানতে। তারপর চেঁচিয়ে কাকে যেন জিগ্যেস করল, যাবি তো?