- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘ফাটকা পুঁজির হাতে চলে যাচ্ছে রাজ্যের চা বাগানগুলি’

ডানকানের চা বাগানগুলির শ্রমিকদের রাস্তা অবরোধ কর্মসূচীর পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিকদের যৌথ সংগ্রাম কমিটির কনভেনর অভিজিত মজুমদারের সঙ্গে কথা বলেন সংবাদমন্থন প্রতিনিধি। অভিজিত মজুমদারের বক্তব্য নিচে দেওয়া হলো।#
চা বাগানের সমস্যা ভয়ঙ্কর। সমস্ত স্পেকুলেটেড বা ফাটকা পুঁজির কারবারিরা চা বাগান ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে ঢুকেছে। যেমন ধরুন, দার্জিলিং-এ তিনটি চা বাগান আছে। কলেজভ্যালি, ধোত্রে এবং পেশক। এই তিনটি চা বাগানের চায়েরই গুণগত দিক দিয়ে নামডাক আছে। দার্জিলিং টি কোয়ালিটির প্রতিনিধিত্ব করে। এদের মালিকানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অ্যালকেমিস্ট কোম্পানি এই তিনটি চা বাগানের মালিক হয়েছে। অ্যালকেমিস্ট মূলতঃ একটি চিট ফান্ড কোম্পানি। কে ডি সিং এর মালিক এবং যিনি এখন তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য। বিভিন্ন চিটফান্ডের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চললেও একটা বড়ো চিট ফান্ড অ্যালকেমিস্ট বসে আছে। যার বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ডানকান গোষ্ঠীর পনেরোটি চা বাগানে যেমন বেতন নেই, রেশন নেই তেমনি কে ডি সিং-এর তিনটি চা বাগানেও গত তিন চার মাস থেকে কোনো রেশন নেই, বেতন নেই। সাথে অন্যান্য বকেয়াও পাচ্ছে না। কে ডি সিং-এর তিনটি চা বাগানের  দেড়-দু হাজার শ্রমিক অর্ধাহারে অনাহারে রয়েছে।
অন্যদিকে সরকার অধিগৃহিত পাঁচটি চা বাগান ছিল। এর মধ্যে তিনটি দার্জিলিং হিল-এ এবং অপরদুটি ডুয়ার্সে। ডুয়ার্সের দুটি চা বাগান হিল টি এস্টেট, মহুয়া টি এস্টেট এবং দার্জিলিং পাহাড়ে আছে পান্নাম টি এস্টেট এবং রঙ্গারুম টি এস্টেট ও রংবুক-সিডার টি এস্টেট। সত্তরের দশক থেকেই এই বাগানগুলো সরকার অধিগ্রহণ করেছিল। দীর্ঘ ৩৫-৪০ বছর ধরে সরকার বাগানগুলো চালিয়েছে। বর্তমান সরকার বাগানগুলো নিলামে চড়িয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। মালিকানা পরিবর্তন ঘটে গেছে। কিন্তু ডুয়ার্সের হিলা-মহুয়া চা বাগানের শ্রমিকরা বাগান বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে লড়েছে। পাহাড়ের তিনটি বাগানের শ্রমিকরাও বিনা লড়াই-এ বেসরকারীকরণ হতে দেয়নি। শেষ অবধি একপেশেভাবে সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে বাগান বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই পাঁচটি চা বাগানের শ্রমিকদের জীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ। তাদের অনেক মিথ্যে কথা বলা হয়েছিল। সরকার বলেছিল, শ্রমিকদের সরকারি চাকরি দেবে। কিন্তু দেয়নি। দার্জিলিং-এর তিনটি বাগান নিয়েছেন সঞ্জয় বনশালরা। এরা কুখ্যাত মালিক। এরাও বিভিন্ন বাগান বন্ধ করে দেওয়া মালিক। এবং ডুয়ার্সের দুটি বাগান যারা নিয়েছেন, অশোক ধররা। কে এই অশোক ধররা? উত্তরবঙ্গের সবথেকে বেশি বছর বন্ধ হয়ে থাকা চা-বাগান, যেখানে সবচেয়ে বেশি চা শ্রমিক মারা গেছে, সেই ঢেঁকলাপাড়া চা বাগান নিয়ে অশোক ধররা বন্ধ করে দিয়েছিল।
এটা একটা খেলা। বন্ধ চা বাগানের ব্যবসা বেশি লাভজনক। বন্ধ বাগান দেখিয়ে মালিকরা দাবি করে, ব্যাঙ্ক আমাকে লোন দাও, আমি বাগান খুলবো। শ্রমিকরা খেতে পাবে। সরকারের টি বোর্ড-এর মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া যায়। এই দুটো উৎস থেকে সহজে টাকা লুঠ করা জন্য বন্ধ বাগানের খেলায় মেতেছে অমানবিক চা মালিকরা। অথচ চা বাগানের বিগত কয়েক বছরের ব্যালান্স অব অ্যাকাউন্ট যাচাই করলে দেখা যায়, কী বিপুল মুনাফা করেছে চা বাগান কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শ্রমিকদের একটি অমানুষিক অবস্থায় রাখা হয়েছে। এটা বঞ্চনার নিষ্টুর ইতিহাস তৈরি করছে।
ফলস্বরূপ অপুষ্টিজনিত মৃত্যু হচ্ছে। কিন্তু সরকার ও মালিকপক্ষ এটা স্বীকার করছে না যে এদের মৃত্যুর মূল কারণ সরকার-মালিক আঁতাতজনিত শ্রমিক বঞ্চনা। এটা প্রমাণ করবার জন্য আমরা ড. বিনায়ক সেনকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে সমীক্ষা চালিয়েছি চা শ্রমিকদের পুষ্টির মাত্রা নিয়ে। বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের ‘বডি-মাস ইন্ডেক্স’ পরীক্ষা করে সরকার-মালিক আঁতাতকে চ্যালেঞ্জ করে পরিসংখ্যান বার করা হয়েছে। সেখানে আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি, বন্ধ বাগানের খাদ্যদ্রব্যের অভাবের কারণেই বহুল অপুষ্টির চিহ্ন তৈরি হচ্ছে এবং অপুষ্টিতেই চা শ্রমিকরা মারা যাচ্ছে। আমরা সরাসরি সমস্ত পরিসংখ্যান ও ড. বিনায়ক সেনের সহযোগিতায় তৈরি রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়েছি। কিন্তু চা-শ্রমিকদের অপুষ্টি দূর করার কোনো পদক্ষেপ গৃহিত হয়নি। চা বলয়ের পরিস্থিতি দিন দিন সঙ্কটের মধ্যে চলে যাচ্ছে।